
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় দিনে-দুপুরে সংঘটিত আরেকটি রক্তাক্ত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছেন যুবদলের এক সক্রিয় নেতা। আজ রোববার (৬ জুলাই) দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের ঈষাণ ভট্টের হাট এলাকায় ওষুধ কিনতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ হারান মো. সেলিম (৪২)। তিনি বিএনপির অঙ্গসংগঠন যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং কদলপুর ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সেলিম এলাকার পরিচিত রাজনৈতিক কর্মী এবং বিএনপির চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকার গ্রুপের ঘনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয় অত্যন্ত পরিকল্পিত ও ঠান্ডা মাথায়, প্রকাশ্য বাজার এলাকায়, দিনের আলোয়, যখন বাজার ও আশপাশে লোকজনের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
নিহতের ফুফাতো ভাই মো. রিদুয়ান জানান, ঘটনার সময় সেলিম তার স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার ও কন্যা সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে ঈষাণ ভট্টের হাট এলাকায় মোটরসাইকেলে করে ওষুধ কিনতে যান। এমন সময় হঠাৎ একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে ৪-৫ জন দুর্বৃত্ত আসে। তাদের মধ্যে দুজন বোরকা পরে ছিল। তারা সেলিমকে লক্ষ্য করে কাছ থেকে গুলি ছোড়ে এবং দ্রুত পালিয়ে যায়।
গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সেলিম মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মাথায় একটি গুলি লাগে, যা তাকে ঘটনাস্থলেই প্রায় মৃত্যুর কোলে ঢেলে দেয়। আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে দ্রুত রাউজান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনার সময় সেলিমের স্ত্রী ও কন্যা পেছনে মোটরসাইকেলে থাকায় তারা সন্ত্রাসীদের খুব কাছ থেকে দেখেন। ফেরদৌস আক্তার বলেন, “জানাজার নামাজ শেষে আমরা বাজারে যাই ওষুধ কিনতে। হঠাৎ একটি সিএনজিতে বোরকা পরিহিত দুই ব্যক্তি এবং আরও কয়েকজন এসে আমার স্বামীর মাথায় গুলি করে চলে যায়। আমি মোটরসাইকেল থেকে পড়ে যাই মেয়েকে নিয়ে। হামলাকারীদের মধ্যে আমি একজনকে চিনেছি—তার নাম দামা ইলিয়াস। বাকিদের চেহারা দেখলে চিনতে পারব।”
রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম ভুঁইয়া ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, “আমরা খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে পৌঁছি। আহত অবস্থায় সেলিমকে হাসপাতালে নেওয়া হয়, কিন্তু চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আমরা ইতোমধ্যে তার মরদেহ সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এটি পূর্বপরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড।”
পুলিশ আরও জানায়, ঘটনার পরপরই সন্দেহভাজনদের শনাক্ত ও আটকের জন্য অভিযান শুরু হয়েছে। স্থানীয় সিসিটিভি ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা এবং নিহতের পরিবারের দেয়া তথ্যে ভিত্তি করে তদন্ত চলছে।
স্থানীয়রা বলছেন, সেলিম রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন এবং বিএনপির ভেতরের একটি শক্তিশালী গ্রুপের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁর সক্রিয়তাই তাঁকে টার্গেটে পরিণত করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঈষাণ ভট্টের হাট এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় আধিপত্য নিয়ে বিএনপির দুটি গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, এবং এ ঘটনাও তারই ধারাবাহিকতা হতে পারে বলে ধারণা।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে রাউজানে রাজনৈতিক সহিংসতার নতুন ঢেউ শুরু হয়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত উপজেলায় অন্তত ১৩টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ১০টিই সরাসরি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত। বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে অন্তত ১০০ বারের বেশি। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তিন শতাধিক মানুষ। এসব ঘটনায় এখনো বহু মামলা চলমান, অধিকাংশ মামলার আসামিরা পলাতক।
এই ঘটনায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রতিদিন বাজারের ব্যস্ত এলাকায় যদি প্রকাশ্যে একজন রাজনৈতিক কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা যায়, তবে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? অনেকেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন—কেন এমন এলাকাগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে না, যেখানে পূর্বে বহু সহিংসতার ইতিহাস রয়েছে?
সুশীল সমাজের অনেকে বলছেন, রাজনীতিতে বিরোধ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু তা যদি অস্ত্র এবং প্রাণঘাতী হামলার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সেটা কেবল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্যই নয়, গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্যও বড় হুমকি।
নিহত সেলিমের পরিবার এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন। তারা বলছেন, “সেলিম কোনো অপরাধী ছিলেন না, তিনি একজন রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তার হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।”
এদিকে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির পক্ষ থেকেও এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানানো হয়েছে। তারা দাবি করেন, ক্ষমতার লড়াইয়ের নামে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় সেলিমকে হত্যা করা হয়েছে এবং প্রশাসন বিষয়টিকে যথাযথভাবে আমলে না নিলে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে।
রাউজানে সেলিম হত্যাকাণ্ড কেবল একটি রাজনৈতিক সহিংসতার নতুন অধ্যায় নয়, এটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে একটি অশনি সংকেতও বটে। যখন দেশব্যাপী নির্বাচনের প্রস্তুতি ও রাজনৈতিক পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চলছে, তখন এ ধরনের হত্যা প্রমাণ করে যে, গ্রাসে রয়েছে অস্থিরতা, এবং প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে, নয়তো আরও অনেক ‘সেলিম’ প্রাণ হারাবে রাজনীতির বলি হয়ে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ