
ছবি: সংগৃহীত
দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ৩১৭ জন। এই সংখ্যা একদিনের হিসেবে উদ্বেগজনক, যদিও আজ কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম রোববার (৬ জুলাই) সকালে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
এই ৩১৭ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে বরিশাল বিভাগে। বিভাগের বিভিন্ন জেলা মিলিয়ে সেখানে ১২৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যা সারাদেশের মোট আক্রান্তের প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বরিশাল বিভাগেই আক্রান্তের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেশি থাকছে। বিশেষ করে বরগুনা জেলাতে পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
বরগুনার সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ১০২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। একদিনে এটিই এ বছরের সর্বোচ্চ আক্রান্তের রেকর্ড। এই জেলায় এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৫৯ জনে। এর মধ্যে ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা সারা দেশের হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত (৬ জুলাই পর্যন্ত) দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১২ হাজার ২৭১ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৪৫ জনের।
তবে যখন বছর ভিত্তিক পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেওয়া হয়, তখন চিত্রটি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ৫৭৫ জন। যদিও চলতি বছরের জুলাই মাস এখনও চলমান, তবুও বছরের প্রথমার্ধেই ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা চিন্তার ভাঁজ ফেলছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কপালে।
অন্যদিকে ২০২৩ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়াবহ। ওই বছর দেশে মোট আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন ১ হাজার ৭০৫ জন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ প্রাণহানির রেকর্ড।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মশার বিস্তার আগের তুলনায় অনেক দ্রুত হচ্ছে। অল্প বৃষ্টিপাতেই পানি জমে থাকার সুযোগে ডেঙ্গু বাহক এডিস মশা বংশবিস্তার করছে এবং দ্রুত ছড়াচ্ছে সংক্রমণ। পাশাপাশি জনসচেতনতার অভাব, যথাযথ মশা নিধন কার্যক্রমের ঘাটতি এবং অনেক এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, বরগুনা ও বরিশালের মতো জেলার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। কারণ স্থানীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত হাসপাতাল সুবিধা না থাকলে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা যথাযথভাবে দেওয়া সম্ভব হবে না। ইতিমধ্যে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে রোগী উপচে পড়ছে বলে জানা গেছে। চিকিৎসক ও নার্স সংকট, আইসোলেশন বেডের অভাবসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর বারবার সাধারণ জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, এডিস মশা প্রধানত সকাল ও বিকেলবেলা কামড়ায়। তাই দিনের এই সময়গুলোতে বাড়ির ভেতরে বা বাইরে মশারি ব্যবহার করা, ফুলদানি বা টবে জমে থাকা পানি ফেলে দেওয়া, বাসা-বাড়ির চারপাশে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং প্রয়োজনে মশা মারার স্প্রে বা কয়েল ব্যবহার করা জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য অনুযায়ী, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আগামী কয়েক সপ্তাহে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। এখনই কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতি আবার ২০২৩ সালের মতো ভয়াবহ হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ে, স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের সক্রিয় অংশগ্রহণে একটি সংঘবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। জনগণের অংশগ্রহণ ও সচেতনতা ছাড়া এটি সম্ভব নয়—এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাবার্তা/এমএইচ