
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের জন্য এক বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ঘোষণাটি। তিনি এক চিঠিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আগামী ১ আগস্ট ২০২৫ থেকে বাংলাদেশের যেকোনো ও সকল রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করবে যুক্তরাষ্ট্র। চিঠিতে ট্রাম্প স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, এই সিদ্ধান্ত মার্কিন অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় অপরিহার্য।
ট্রাম্পের চিঠিটি শুধু একটি কূটনৈতিক বার্তা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বার্তাবাহকও। এতে তিনি যে ‘বাণিজ্যিক ভারসাম্য’ এবং ‘ন্যায্যতার’ ওপর জোর দিয়েছেন, তা ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নতুন করে ভাবনার দাবি রাখে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর চিঠিতে বলেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি দীর্ঘমেয়াদী এবং ক্রমাগত বাড়ছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।” তিনি এও উল্লেখ করেন, “বাংলাদেশের শুল্ক ও অশুল্ক নীতি এবং বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি অসন্তোষজনক পরিবেশ তৈরি করেছে।”
ট্রাম্প বলেন, “এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু আমাদের বাণিজ্য ঘাটতির প্রতিকার হিসেবে এটি ন্যায্য এবং যুক্তিযুক্ত।” তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের ‘এক নম্বর বাজার’ হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন—যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে শুল্ক ছাড় সুবিধা নেওয়ার জন্য।
চিঠিতে উল্লেখ আছে: "বাংলাদেশ যদি তার শুল্ক ও অশুল্ক নীতি পরিবর্তন করে এবং বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা দূর করে, তাহলে আমরা এই শুল্ক পুনর্বিবেচনার সুযোগ রাখছি।"
ট্রাম্পের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের কাঠামো ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ’। তিনি বলেন, “দু’দেশের সম্পর্ক পারস্পরিক বিনিময়ের ধারেকাছেও নেই।” তার দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশের নীতি দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। তিনি এটিকে ‘নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবেও অভিহিত করেছেন।
চিঠিতে এমন ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে যে, যদি বাংলাদেশ ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর কোনো শুল্ক আরোপ করে, তাহলে সেই শুল্ককে ‘৩৫ শতাংশের সঙ্গে যোগ’ করে প্রতিশোধমূলক হার আরোপ করা হবে।
চিঠিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বিকল্প পথও খোলা রেখেছেন। তিনি লিখেছেন, “যদি কোনো বাংলাদেশি কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে কারখানা স্থাপন করে এবং পণ্য উৎপাদন শুরু করে, তাহলে সেই পণ্যের ওপর কোনো শুল্ক আরোপ করা হবে না।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এই প্রক্রিয়াকে দ্রুত ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করতে চাই, যাতে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কোম্পানিগুলো কার্যক্রম শুরু করতে পারে।”
ট্রাম্পের এই চিঠি এমন এক সময় এল, যখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চাপ, রাজনৈতিক পুনর্গঠন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রত্যাশার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না দিলেও, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বলছে—এই শুল্ক ঘোষণার কারণে তৈরি পোশাক, চামড়া, ওষুধ, হস্তশিল্পসহ বেশ কয়েকটি খাতে রপ্তানিতে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি বাজার। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত, যা বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশ জুড়ে আছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মারাত্মক চাপে পড়বে। এই শুল্ক আরোপের ফলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে, কারণ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো যেমন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মেক্সিকো, এমনকি আফ্রিকান কিছু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নানা রকম বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে।
চিঠিতে ট্রাম্প পূর্ববর্তী কিছু প্রশাসনিক নীতির বিরুদ্ধেও আকারে-ইঙ্গিতে সমালোচনা করেছেন। যেমন, ওবামা প্রশাসনের সময় বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে দেওয়া হলেও সরাসরি এমন শুল্ক আরোপের ঘটনা ঘটেনি। ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও চাপ তৈরি করতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই চিঠি নিছক কূটনৈতিক বার্তা নয়—এটি একটি অর্থনৈতিক হুঁশিয়ারি। ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ বাংলাদেশের রপ্তানি শিল্পের জন্য গুরুতর আঘাত হয়ে দাঁড়াতে পারে, যদি না দ্রুত কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার পথ খোঁজা হয়।
বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনায় বসা, নিজেদের বাণিজ্য নীতির ন্যায়সংগত দিক তুলে ধরা, এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানো—এই ধরনের সিদ্ধান্ত কেবল বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্রেরও ভোক্তা পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
চিঠির ভাষা এবং বার্তার অন্তর্নিহিত বার্তা স্পষ্ট—যুক্তরাষ্ট্র চায় বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণ, আর বাংলাদেশকে তার শর্তেই অংশ নিতে হবে—অথবা মূল্য দিতে হবে। এখন দেখার বিষয়, ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার এই কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের কী উত্তর দেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ