
ছবি: সংগৃহীত
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের তরুণ ভোটারদের রাজনৈতিক মনোভাব ও পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করেছে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও একশনএইড বাংলাদেশ। জরিপে উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য: নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত থাকা আওয়ামী লীগকে পেছনে ফেলে সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্তির দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে বিএনপি।
জরিপ অনুযায়ী, তরুণ ভোটারদের মধ্যে ৩৮.৭৬ শতাংশ বিএনপিকে ভোট দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী, যারা পেয়েছে ২১.৪৫ শতাংশ সমর্থন। আশ্চর্যজনকভাবে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), যাদের পক্ষে রয়েছে ১৫.৮৪ শতাংশ তরুণ ভোটারের সমর্থন।
আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে জরিপটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়। দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন স্থগিত থাকায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো নিশ্চয়তা না থাকলেও, ১৫.৮৪ শতাংশ তরুণ এখনো তাদের ভোট দিতে আগ্রহী।
২০২৪ সালের ২০ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত দেশের আট বিভাগের প্রতিটি থেকে দুটি জেলা এবং সেসব জেলার দুটি করে উপজেলার ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী মোট ২ হাজার তরুণ (নারী ও পুরুষ) এই জরিপে অংশ নেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭৬.৭৮ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, তারা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে চান। ৫.৯ শতাংশ এখনো সিদ্ধান্তহীন, ৪.১৪ শতাংশ ভোট দেবেন না বলে জানিয়েছেন এবং ১৩.৯৮ শতাংশ এখনো ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হননি।
জরিপে দেখা গেছে, রাজনৈতিক তথ্যের জন্য তরুণদের অন্যতম নির্ভরযোগ্য উৎস এখন সামাজিক মাধ্যম। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্তত ৮৭.৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক কিংবা অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকেই রাজনীতি বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করেন।
প্রচলিত দলগুলোর তুলনায় তরুণ নেতৃত্বের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আশাবাদী ৪২ শতাংশের বেশি তরুণ। তরুণদের চাহিদা ও প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলো কতটা উপস্থাপন করতে পারছে—এমন প্রশ্নে ৩০ শতাংশ কিছুটা সন্তুষ্ট, তবে ৪০.২৪ শতাংশ নিশ্চিত নন।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি উন্নয়নে সহায়ক কিনা—এ প্রশ্নে তরুণদের মতামত দুই ভাগে বিভক্ত। জরিপে ৫১.৭৭ শতাংশ মনে করেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি দেশের জন্য সহায়ক। বিপরীতে, ৪৮.২৩ শতাংশ একে সহায়ক মনে করেন না। তবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান নিয়ে ৩৮.৩ শতাংশ তরুণ উদ্বিগ্ন, ১১.৪ শতাংশ একেবারে উদ্বিগ্ন নন এবং ৩০ শতাংশ বলেছেন, তারা মাঝে মাঝে উদ্বিগ্ন হন বা বিষয়টি নিয়ে নিরপেক্ষ।
ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো আগামী পাঁচ বছরে ক্ষমতায় আসতে পারে—এমন বিশ্বাস পোষণ করেন জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ১১ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে ২২.৫ শতাংশ বলেছেন, এই দলগুলো কখনোই ক্ষমতায় আসবে না। সবচেয়ে বড় অংশ, প্রায় ৩৯ শতাংশ, এই বিষয়ে মতামত দিতে পারেননি বা জানেন না।
৬০ শতাংশের বেশি তরুণ রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে একমত হয়েছেন—বিশেষ করে রাজনৈতিক সহিংসতা, পৃষ্ঠপোষকতা ও স্বজনপ্রীতি দূর করার ক্ষেত্রে। এটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে, রাজনীতির প্রতি তরুণ সমাজ আগ্রহী হলেও তারা চান একটি সুশৃঙ্খল, জবাবদিহিতামূলক ও নীতিনিষ্ঠ রাজনৈতিক পরিবেশ।
জরিপের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে অংশ নেন একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে তরুণরা আগ্রহী হলেও তারা মূলত সুবিধা পাওয়ার আশায় রাজনীতিতে আসেন, আদর্শ বা পরিবর্তনের উদ্দেশ্য নিয়ে নয়।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থান তরুণদের মাধ্যমে সংঘটিত হলেও নীতিনির্ধারণের স্তরে তাদের কোনো অবস্থান নেই। সুযোগ কাজে না লাগাতে পারলে যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে, সেটি অধরাই থেকে যাবে।’
শিক্ষা ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবরাও এই অনুষ্ঠানে তরুণদের রাজনৈতিক সচেতনতাকে সময়োপযোগী ও ইতিবাচক বলে অভিহিত করেন।
এই জরিপ শুধু রাজনৈতিক পছন্দের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং তরুণদের রাজনৈতিক চেতনার গভীরতা, তাদের চাহিদা এবং আগামী দিনের রাষ্ট্রনীতির রূপরেখার প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত। তরুণদের মতামত এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি তাদের প্রত্যাশা আগামী নির্বাচনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। তবে এই শক্তিকে কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে হলে দরকার হবে রাজনৈতিক সংস্কার এবং নেতৃত্বে তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার সাহসী পদক্ষেপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ