
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম ও পোল্যান্ডের গডানস্ক সমুদ্রবন্দরের মধ্যে সরাসরি নৌপথ চালুর সম্ভাবনা নিয়ে গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. ময়নুল ইসলাম এবং গডানস্ক বন্দর কর্তৃপক্ষের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে। ওয়ারশ’র স্থানীয় সময় ৭ জুলাই সোমবার, গডানস্ক বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই বৈঠককে দুই দেশের বন্দর ও লজিস্টিক খাতের সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বৈঠকে গডানস্ক বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষে নেতৃত্ব দেন বন্দরের ফাইন্যান্স অ্যান্ড সিকিউরিটি বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যালান আলেকসান্ড্রোইচ। শুরুতেই তিনি রাষ্ট্রদূতকে বন্দরটির কার্যক্রম, আধুনিক অবকাঠামো, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক লজিস্টিক নেটওয়ার্কে গডানস্ক বন্দরের কৌশলগত অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করেন।
বৈঠকে দুই পক্ষই জোর দেন চট্টগ্রাম এবং গডানস্ক বন্দরের মধ্যে সরাসরি শিপিং রুট স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ওপর। উভয়েই একমত হন যে, একটি সরাসরি নৌযোগাযোগ গড়ে উঠলে তা কেবল বাংলাদেশ ও পোল্যান্ড নয়, বরং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্যিক সংযোগকে ত্বরান্বিত করবে। এই নৌপথ ভবিষ্যতে চীনের সঙ্গে ইউরোপের সংযোগ পথ হিসেবেও বিকল্প একটি করিডোর হয়ে উঠতে পারে বলে মত দেন উভয়পক্ষের বিশেষজ্ঞরা।
রাষ্ট্রদূত ময়নুল ইসলাম বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার একটি প্রবেশদ্বার। এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ইউরোপের যোগাযোগ জোরদারে গডানস্ক বন্দরের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ একটি বিপুল সম্ভাবনা তৈরি করবে।”
বৈঠকে আলোচিত হয় কিভাবে দুই বন্দর পারস্পরিক অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বিনিময়ের মাধ্যমে নিজেদের অপারেশনাল সক্ষমতা বাড়াতে পারে। আধুনিক বন্দর ব্যবস্থাপনা, কাস্টমস ডিজিটালাইজেশন, সাইবার নিরাপত্তা, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট এবং গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন নিয়ে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগির কথা হয়।
এছাড়া, কন্টেইনার হ্যান্ডলিং, মালবাহী জাহাজের গতি ও নৌযান পরিচালনা বিষয়েও যৌথ প্রশিক্ষণ এবং স্টাফ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়।
উভয় পক্ষ সম্মত হয়, চট্টগ্রাম ও গডানস্ক বন্দর সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের অংশগ্রহণে একটি ভার্চুয়াল টেকনিক্যাল মিটিং আয়োজন করা হবে। যেখানে দুই দেশের বন্দর অপারেটর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, শিপিং কোম্পানির প্রতিনিধি, আমদানি-রপ্তানিকারক এবং লজিস্টিক খাতের ব্যক্তিরা অংশ নিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করবেন।
এই মিটিংয়ে সম্ভাব্য পাইলট প্রকল্প, মালবাহী শিপিং রুট এবং কনটেইনার ট্রানজিট স্টাডি নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ময়নুল ইসলাম জানান, এই আলোচনা কেবল দুই বন্দর নয় বরং বাংলাদেশ ও পোল্যান্ডের অর্থনৈতিক কৌশলগত অংশীদারিত্বকে একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে। পোল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতির দেশ হওয়ায়, চট্টগ্রাম-গডানস্ক নৌপথ কার্যকর হলে সেটি বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের জন্য ইউরোপে পণ্য পৌঁছানোর সময় ও খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনবে।
এছাড়া গার্মেন্টস, ফার্মাসিউটিক্যালস, হিমায়িত খাদ্য, চামড়া ও হালকা প্রকৌশল পণ্যের জন্য পোল্যান্ড হয়ে ইউরোপের নতুন বাজার উন্মোচনের সম্ভাবনা তৈরি হবে।
প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রদূত মো. ময়নুল ইসলাম ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের পর ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) দায়িত্ব পান। তার অধীনে পুলিশ বাহিনীর ভেতরে শৃঙ্খলা ও সংস্কার কর্মসূচির প্রশংসা হয় দেশব্যাপী।
পরবর্তীতে তিনি সরকারি চাকরি থেকে স্বাভাবিক নিয়মে অবসরোত্তর ছুটিতে গেলে, সরকার তার এই ছুটি স্থগিত করে পরবর্তী দুই বছরের জন্য তাঁকে পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়। গত ২ জুলাই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পোল্যান্ডের রাষ্ট্রপতির কাছে পরিচয়পত্র পেশ করেন।
চট্টগ্রাম-গডানস্ক সরাসরি নৌযোগাযোগ গড়ে তোলা এখন আর কেবল ধারণা নয়, বরং তা বাস্তবায়নের পথে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপও সম্পন্ন হয়েছে। এই আলোচনা এবং পরবর্তী পরিকল্পিত কার্যক্রম সফল হলে তা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এটি শুধু দুই বন্দর নয়, দুই জাতির অর্থনৈতিক স্বপ্নকেও জোড়া লাগাবে একটি কৌশলগত নৌপথের মাধ্যমে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ