
ছবি: সংগৃহীত
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টিতে (জাপা) গভীর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নেতৃত্ব সংকট সৃষ্টি হয়েছে। দলের অভ্যন্তরীণ বিবাদ নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে গতকাল থেকে, যখন পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের মহাসচিব পদ থেকে মুজিবুল হক চুন্নুকে বাদ দিয়ে শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে নিয়োগ দেন। এই একক সিদ্ধান্তের ফলে দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার প্রতিবাদে উঠে আসেন এবং বিষয়টি ‘অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক’ বলে উল্লেখ করেন।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে কোনো কারণ ছাড়াই বহিষ্কার করে পার্টির গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত পার্টির নেতৃত্ব ও গঠনকে নষ্ট করার প্রচেষ্টা।’ তাঁরা আরও বলেন, ‘জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের ঘোষিত কাউন্সিল হওয়ার আগে এমন একক সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অবৈধ। এটি পার্টির গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে দিয়েছে এবং স্বৈরাচারী শাসনের মতো আচরণ।’
এই পরিস্থিতিতে তাঁরা দলের সব ত্যাগী ও আদর্শবান নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই অন্যায় ও একনায়কতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। ‘আমরা চাই জাতীয় পার্টিকে সুসংগঠিত করা হোক, ব্যক্তিকে নয়, গঠনতন্ত্র ও ন্যায়ের পথে ফিরিয়ে আনা হোক।’
জি এম কাদের এই প্রতিবাদের জবাবে জাতীয় পার্টির দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন, যেখানে বলা হয়, ২৮ জুন পার্টির প্রেসিডিয়াম সভায় দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার ও মুজিবুল হক চুন্নুকে দলের সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এই ঘোষণার পর থেকেই জাপায় ব্যাপক অস্থিরতা ও বিভাজনের সৃষ্টি হয়। পার্টির অভ্যন্তরে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়া জটিলতায় পড়ে।
দীর্ঘদিন ধরেই অস্থিরতায় ভুগছে জাতীয় পার্টি। বারবার ভাঙার খেলায় তেঁতুল ওঠা দলটির মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধ আরও প্রকট হয়েছে। ২৮ জুন দলের জাতীয় সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন জি এম কাদের। এই সম্মেলনের মধ্যেই নতুন নেতৃত্ব গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় নেতাদের দ্বারা। বিশেষত, কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব পদপ্রার্থী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেন।
তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে ২৮ জুনের সম্মেলন স্থগিত হয়। এর মধ্যেই জি এম কাদের একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে মহাসচিব পরিবর্তন করেন, যা দলের ভিতরে বড় ধরনের সংঘাত সৃষ্টি করেছে।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলয় ২৮ জুন কাউন্সিল করার ব্যাপারে অনড় থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারা পিছু হটেন। তবে তাঁরা চেয়ারম্যানকে দ্রুত সময়ে কাউন্সিল করার আলটিমেটাম দেন। তাদের হুঁশিয়ারি ছিল, ‘যদি দ্রুত কাউন্সিল না হয়, তাহলে তারা পাল্টা কাউন্সিল ডেকে নতুন কমিটি গঠন করবেন।’
জাতীয় পার্টির বর্তমান এই অস্থিরতা ও নেতৃত্ব সংকট দলটির ভবিষ্যৎকে নিয়েই নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। পার্টির গঠনতন্ত্র ও আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বার্থপরতা দলের ঐক্য ও শৃঙ্খলাকে বড় ধরনের আঘাত দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবস্থায় পার্টির নেতারা যদি দ্রুত ঐক্যবদ্ধ না হন, তাহলে দলটি বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট ও পতনের মুখোমুখি হতে পারে।
বর্তমান সময়ই জাতীয় পার্টির জন্য নিজেদের ভাঙা বিভাজন কাটিয়ে উঠে গণতান্ত্রিক ও শৃঙ্খলাবদ্ধ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার অন্যতম সুযোগ। তবে সেটি কতটুকু সম্ভব হবে, তা সময়ই বলবে।
জাতীয় পার্টির এই গভীর সংকট ও নেতৃত্ব দ্বন্দ্ব দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ নজর কাড়ছে। আগামী দিনে পার্টির পক্ষ থেকে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং দলের সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা, তা দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ