
ছবি: সংগৃহীত
কক্সবাজারের হিমছড়ি সমুদ্রসৈকতের উত্তাল ঢেউয়ে তলিয়ে গেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের তিন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, বাকি দুইজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। নিখোঁজদের উদ্ধারে স্থানীয় প্রশাসন ও উদ্ধারকর্মীরা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে সোমবার (৭ জুলাই) সন্ধ্যার দিকে, যখন চারজন শিক্ষার্থী বন্ধুরা মিলে বেড়াতে গিয়ে হিমছড়ি সৈকতে নেমেছিলেন। পরদিন মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকে সমুদ্রসৈকতের হিমছড়ি পয়েন্ট থেকে একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নিহত শিক্ষার্থীর নাম কে এম সাদমান রহমান (২০), তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মো. ফরহাদ হোসেন হলের আবাসিক ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি ঢাকার মিরপুর এলাকায়। নিহত সাদমান রহমানের বাবা কে এম আনিছুর রহমান ঘটনার খবর পেয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।
এ ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন দুই শিক্ষার্থী—আসিফ আহমেদ ও অরিত্র হাসান। তারা দুজনেই বগুড়া জেলার বাসিন্দা এবং চবির একই বিভাগের ও একই আবাসিক হলের শিক্ষার্থী। তিনজনই প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে মাত্র কয়েক মাস হলো বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে পা দিয়েছিলেন।
চবির সহকারী প্রক্টর এবং ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাঈদ বিন কামাল চৌধুরী বলেন, “সোমবার রাতে বিভাগের চারজন শিক্ষার্থী ঘুরতে যান কক্সবাজারে। তারা কেউ আমাদের জানায়নি, নিজেরাই গিয়েছেন। আমাদের ধারণা, অতিরিক্ত উত্তাল সাগরের ঢেউ বুঝতে না পেরে তারা পানিতে নেমেছিলেন। তিনজন হঠাৎ করে স্রোতে ভেসে যান। পরে স্থানীয় জেলেরা একজনের মরদেহ উদ্ধার করেন। বাকি দুইজন এখনো নিখোঁজ।”
তিনি আরও জানান, “ঘটনার পরপরই আমরা কক্সবাজারের স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। নিহত ও নিখোঁজদের পরিবারকে জানানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কয়েকজন শিক্ষক আজই কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।”
হিমছড়ি তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক সোমনাথ বসু জানান, “বন্ধুরা একসঙ্গে হিমছড়ির সমুদ্রসৈকতে নেমেছিলেন। সে সময় সাগরে ছিলো প্রচণ্ড ঢেউ ও স্রোত। তারা বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়েই পানিতে নামেন। পরে তিনজন শিক্ষার্থী ভেসে যান। আমরা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদের সহযোগিতায় উদ্ধারকাজ চালাচ্ছি। ইতোমধ্যে একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, বাকি দুজনের সন্ধানে অভিযান চলছে।”
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সমুদ্রসৈকতের বেশ কিছু পয়েন্টে আগেই সতর্কতামূলক লাল পতাকা টানিয়ে রাখা হয়েছিল, যা মানা হয়নি। সম্প্রতি আবহাওয়া অধিদপ্তর ও সমুদ্র নিরাপত্তা সংস্থাগুলো কক্সবাজারসহ উপকূলীয় এলাকায় সাগর উত্তাল থাকার বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছিল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তাদের সহপাঠীরা জানান, “আমরা বিশ্বাসই করতে পারছি না যে এমনটি ঘটেছে। তারা খুব হাসিখুশি ছিল, ভালো ছাত্রও ছিল। এত দ্রুত এভাবে একজনকে হারাতে হবে, ভাবতেও পারছি না।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিখোঁজদের উদ্ধারে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে এবং প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল কক্সবাজারে পাঠানো হবে।
এই ঘটনাটি আবারও কক্সবাজারে পর্যটকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং সচেতনতার ঘাটতির বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। স্থানীয় পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, “প্রতিবছর এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কিন্তু প্রশাসনের তরফ থেকে কোনো দৃশ্যমান প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয় না। কোথাও পর্যাপ্ত লাইফগার্ড নেই, সতর্ক সংকেত থাকলেও কেউ তা মানে না, আবার পর্যটকদেরও সচেতনতা অত্যন্ত কম।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ তিন শিক্ষার্থীর ঘুরতে গিয়ে একসঙ্গে এমন দুঃখজনক পরিণতি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গোটা জাতিকেই ব্যথিত করেছে। একজনের মৃত্যু ও দুইজনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় পরিবার, সহপাঠী ও শিক্ষকরা শোকাহত।
এখন সবচেয়ে জরুরি হলো নিখোঁজ দুই শিক্ষার্থীকে দ্রুত উদ্ধারে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধে উপকূলীয় পর্যটন এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা। অতিরিক্ত স্রোতের সময়ে সমুদ্রসৈকতে যাতায়াত সীমিত করা এবং পর্যটকদের সচেতন করাও এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ