
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতি দীর্ঘ সময় ধরে নানা ধরনের চাপ ও সংকটের মুখোমুখি হলেও সাম্প্রতিক সময়ের একটি উজ্জ্বল দিক হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অভূতপূর্ব বৃদ্ধি। ২০২৫ সালের জুন মাসে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০২৪ সালের শুরুতে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। মাত্র ১১ মাসের ব্যবধানে এই রিজার্ভের ব্যাপক বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে রেকর্ড রেমিট্যান্স প্রবাহকে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে যে, এই রেমিট্যান্স প্রবাহ শুধু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্বস্তি এনে দেয়নি, বরং সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিকেই চাঙ্গা করতে সহায়তা করেছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে যে দীর্ঘদিন ধরে তারল্য সংকট, ডলার ঘাটতি ও এলসি খোলার জটিলতা চলছিল, তা এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতিতে আস্থার সংকট কাটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মোট ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা একক অর্থবছরে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্সের নতুন রেকর্ড। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ২৬ দশমিক ৮০ শতাংশ।
এদিকে, আইএমএফের বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাব করলে নিট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
রেমিট্যান্সের এই প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে নানা কারণ। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, সর্বপ্রথম গুরুত্ব পাচ্ছে প্রবাসীদের মধ্যে হুন্ডির পরিবর্তে বৈধ চ্যানেল ব্যবহারে উৎসাহ এবং সরকারের নেওয়া প্রণোদনা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানি লন্ডারিং রোধে নেওয়া কঠোর পদক্ষেপ, বৈদেশিক আয়কে দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করার সচেতনতা, রপ্তানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও সংস্কার উদ্যোগ।
২০২৫ সালের মার্চ মাসে একক মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের প্রতিটি মাসেই রেমিট্যান্স এসেছে গড়ে ২ বিলিয়নের বেশি, যা পূর্ববর্তী কোনো অর্থবছরে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের নিচে ছিল এবং ডলারের বাজারে প্রচণ্ড চাপ ছিল। অথচ এখন রিজার্ভ ৩১ বিলিয়নের ওপরে এবং ডলারের মূল্য অনেকটা স্থিতিশীল অবস্থায়, যা আমাদের নেয়া পদক্ষেপগুলোর ফল।’
তিনি বলেন, বর্তমানে ডলারের বিনিময় হার প্রায় ১২২ টাকায় স্থির রয়েছে। এটি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স—উভয় ক্ষেত্রেই একটি ভারসাম্যপূর্ণ হার হিসেবে কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে। সেই সঙ্গে রপ্তানি ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। পুঁজি বাজারে মূল্য কারসাজি ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর দীর্ঘ সময় ধরে ডলার সংকটের ছায়া ছিল। ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে পারছিল না, আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল, বিদেশি ঋণ পেতে সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু এখন রেমিট্যান্সের এই জোয়ার অনেক সমস্যা নিরসনে সহায়ক হচ্ছে।’
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে, ব্যাংকিং খাতে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দাপট কমাতে প্রশাসনিক ও নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
ড. জাহিদ আরও বলেন, ‘সংকট পুরোপুরি কেটে গেছে বলা যাবে না, তবে আমরা একটি মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থার দিকে যাচ্ছি। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি প্রবাহ যদি এই ধারা ধরে রাখতে পারে, তবে আগামী দুই অর্থবছরে রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়।’
প্রিমিয়ার ব্যাংক পিএলসির ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর আবদুল কাইউম চৌধুরী জানান, ‘২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ধারাবাহিকভাবে রেমিট্যান্স বাড়ছে। এই প্রবণতা অন্তর্বর্তী সরকারকে অনেকটা স্বস্তি দিয়েছে। কারণ তখন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমে যাচ্ছিল।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতিতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে—মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব ঘাটতি, বেকারত্ব ইত্যাদি। এই অবস্থায় রেমিট্যান্স প্রবাহ এক বিশাল স্বস্তি।’
চৌধুরী আরও বলেন, প্রবাসীদের মধ্যে দেশে বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়ছে, বিশেষ করে হালাল বিনিয়োগ প্রকল্প ও হাউজিং প্রকল্পে তারা এখন ঝুঁকছে। ফলে ব্যাংক খাতেও তারল্য বাড়ছে, যা নতুন ঋণ প্রদান ও শিল্প খাত পুনরুজ্জীবনে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স আসার হার যদি আরও বাড়ে, তবে শুধু রিজার্ভ নয়—বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্ত ভিত গড়তে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তবে তারা এটাও মনে করেন যে, রেমিট্যান্সের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাই এই প্রবাহ ধরে রাখা ও বহুমুখীকরণ—উভয় পদক্ষেপই প্রয়োজন।
সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের সবাই যদি একযোগে এই সাফল্য ধরে রাখার জন্য কাজ করে, তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক শক্তিশালী ও স্থিতিশীল ভিত্তিতে দাঁড়াতে পারবে—এমন আশাবাদ প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ