
ছবি: সংগৃহীত
চলমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বাংলাদেশ অর্থনীতির গতি কিছুটা বাড়িয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ ২০২৫ সালের জানুয়ারি-মার্চ মেয়াদে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশে। সরকারিভাবে এই তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS)। আগের দুই প্রান্তিকের তুলনায় এটি একটি ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০২৪) জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০২৪) এই হার কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশে। আর সদ্য সমাপ্ত তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ, ২০২৫) তা আরও কিছুটা বেড়ে ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশে পৌঁছেছে, যা চলতি অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এই তিন প্রান্তিকের ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, অর্থনীতি ধীরে ধীরে গতি ফেরাতে শুরু করেছে। বিশেষ করে প্রথম প্রান্তিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্দোলনের কারণে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন কার্যক্রমে যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছিল, তা কিছুটা কাটিয়ে উঠছে দেশ।
উৎপাদন ও খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ
জিডিপির এই প্রবৃদ্ধির হিসাব তিনটি প্রধান খাত—কৃষি, শিল্প ও সেবা—ভিত্তিকভাবে করা হয়। ২০২৫ সালের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে এই তিন খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে শিল্প খাতে। বিস্তারিত বিশ্লেষণ নিচে দেওয়া হলো:
কৃষি খাত: ২ দশমিক ৪২ শতাংশ
কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে কম হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চলমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং বাজারে কৃষিপণ্যের দাম স্থিতিশীল না থাকা এর অন্যতম কারণ।
শিল্প খাত: ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ
এই খাতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মূলত উৎপাদনশীল শিল্প, নির্মাণ খাত এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহে উৎপাদন বাড়ার ফলেই শিল্প খাতে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি এসেছে।
সেবা খাত: ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ
ব্যাংকিং, বাণিজ্য, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ধীরে ধীরে গতি ফেরায় সেবা খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধিও উল্লেখযোগ্য ছিল।
বিবিএসের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে স্থির মূল্যে অভ্যন্তরীণ মোট মূল্য সংযোজন হয়েছে ৮ লাখ ৯২ হাজার ২০ কোটি টাকা। এই অংক পূর্ববর্তী প্রান্তিকের তুলনায় বেশি। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) এটি ছিল ৮ লাখ ৮৬ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা, আর প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ছিল ৮ লাখ ৪ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা।
এই তথ্যগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, ধারাবাহিকভাবে দেশের উৎপাদন ও মূল্য সংযোজন বাড়ছে, যদিও তা এখনও সরকার ঘোষিত বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কিছুটা কম।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুটা ছিল অর্থনীতির জন্য কঠিন। বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন, শ্রমিক অসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা তৈরি করে। ফলে প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অনেকটাই পড়ে গিয়ে ১ দশমিক ৮১ শতাংশে এসে ঠেকে। সরকার তখন নীতিনির্ধারণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়—যেমন ব্যাংক সুদের হার ঊর্ধ্বমুখী করাসহ আর্থিক শৃঙ্খলা আনতে নানা পদক্ষেপ।
পরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। বিশেষ করে রপ্তানি বাণিজ্য ও নির্মাণ খাতের কিছু সাফল্য অর্থনীতিতে নতুন বার্তা আনে। এরই ধারাবাহিকতায় তৃতীয় প্রান্তিকে সামান্য হলেও প্রবৃদ্ধি বাড়ে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামো ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে তৃতীয় প্রান্তিকে ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও এটি কাঙ্ক্ষিত নয়। কারণ, জাতীয় বাজেটে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ শতাংশ। সেদিক থেকে তৃতীয় প্রান্তিকে অর্জিত প্রবৃদ্ধি এখনও লক্ষ্যমাত্রার নিচে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, “চতুর্থ প্রান্তিক ভালো না হলে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশও ছুঁতে পারবে না। শিল্প ও সেবা খাত প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হলেও কৃষিতে স্থবিরতা একটি বড় উদ্বেগ।”
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ—রপ্তানি আয় বাড়ানো, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি এবং কৃষিখাতকে আরও উৎপাদনশীল করে তোলা। একই সঙ্গে রাজস্ব আহরণ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ও বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় একাধিক নীতিগত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে। তবে এই উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়ন এবং জবাবদিহি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি—অবশ্যই একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। তবে সামগ্রিকভাবে এটি এখনও লক্ষ্যচ্যুত অর্থনীতির চিত্রই উপস্থাপন করে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের জন্য এটি একটি সতর্ক সংকেত, যাতে করে শেষ প্রান্তিকে পূর্ণোদ্যমে কাজ করে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন নিশ্চিত করা যায় এবং অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ