
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী ১ আগস্ট থেকে এ শুল্ক কার্যকর হলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের ওপর ভয়াবহ চাপ আসবে বলে আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারক, শিল্পপতি ও অর্থনীতিবিদরা। শুল্ক বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দেশের ৮০১টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান তাদের মোট রপ্তানির অর্ধেকেরও বেশি যুক্তরাষ্ট্রে করে, অর্থাৎ একক মার্কেটের ওপর তাদের নির্ভরতা অত্যন্ত উচ্চমাত্রার।
ফরচুন অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সালাম জানান, “আমাদের সব রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রেই যায়। এর আগে থেকেই আমরা চীনের মতো প্রতিযোগীদের চেয়ে ১০-১৫ শতাংশ বেশি শুল্ক দিচ্ছি। এখন যদি তার ওপর আরও ৩৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক বসানো হয়, তাহলে আমাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের মার্কিন ক্রেতারাও চিন্তিত। তারা সিগন্যাল দিচ্ছে—শুল্ক না কমলে তারা অন্য দেশ থেকে পণ্য কিনবে। এতে শুধু আমাদেরই ক্ষতি হবে না, কর্মসংস্থানেও বড় ধরনের ধস নামবে।”
একই উদ্বেগ প্রকাশ করেন ইনডিপেনডেন্ট অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব। তার ভাষায়, “ওয়ালমার্টসহ যুক্তরাষ্ট্রের বহু প্রতিষ্ঠান আমাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছে। কিন্তু রপ্তানি মূল্য যদি ৫০ শতাংশ শুল্কে আরও বেড়ে যায়, তখন তারা আর আমাদের দিকে তাকাবে না। এটা কেবল রপ্তানির ধাক্কা নয়, এটা শিল্প কাঠামোর ওপর একটা সরাসরি আঘাত।”
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৭৭টি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে ৮০১টি প্রতিষ্ঠানের রপ্তানির ৫০ শতাংশের বেশি গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। এদের অনেকে আবার পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর—তাদের রপ্তানি অন্য কোনো দেশে হয় না। এমন ১৬৮টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের সব রপ্তানি মার্কিন বাজারেই যায়।
এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ এখন বড় ধরনের অনিশ্চয়তায় ঘেরা। তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জুতা, টুপি, তাঁবু, ব্যাগ, আসবাবপত্র এবং হিমায়িত খাদ্যপণ্যের মতো পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির শীর্ষে রয়েছে।
বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সেলিম রহমান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের জন্য এটা মূর্তিমান দুর্যোগ। যারা মনে করছে বিকল্প বাজারে যাবে, তাদেরও বুঝতে হবে—সবাই তখন বিকল্প বাজারেই ঝাঁপাবে। সেখানে প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে, ফলে দাম কমে যাবে, লাভজনক ব্যবসা আর হবে না।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর গবেষক ড. মাহমুদ হাসান বলেন, “বাজার বৈচিত্র্য না থাকলে বড় ক্রেতার শুল্ক নীতির প্রভাব পড়েই। এটা বহু বছর ধরে বলা হচ্ছিল। এখন শুল্ক বাড়ানোর ফলে আমরা সেই পূর্বাভাসের বাস্তবতা দেখছি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তি শুল্ক মানে শুধু কম রপ্তানি নয়—এর অর্থ হচ্ছে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে যাওয়া, হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হওয়া এবং ব্যাংক খাতেও চাপ সৃষ্টি হওয়া। সরকারকে এখনই কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্তরে একসঙ্গে কাজ শুরু করতে হবে।”
শুধু পোশাক নয়, খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রেও শুল্কের কারণে নতুন সংকট দেখা দিচ্ছে। কর্ণফুলী উপজেলার মাসুদ অ্যাগ্রো প্রসেসিং ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড গত ১৩ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে হিমায়িত পণ্য রপ্তানি করছে। প্রতিষ্ঠানটির এমডি আশরাফ হোসেন বলেন, “তিন মাস আগে প্রথম শুল্ক বাড়ানোর খবরে কয়েকটি ক্রেতা আমাদের সঙ্গে চুক্তি স্থগিত করেছিল। এখন আবার নতুন শুল্কের ঘোষণা আসায় সবাই পণ্য নেওয়ার বিষয়ে অনিচ্ছা প্রকাশ করছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা যেসব লাইসেন্স, মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি মেনে চলি, সেগুলোর জন্য বহু অর্থ ও সময় বিনিয়োগ করি। এখন যদি শুল্ক বাড়ে, তাহলে আমাদের সেই বাজার থেকে ছিটকে পড়তে হবে।”
গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৮৭৬ কোটি ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক থেকেই এসেছে ৭৫৯ কোটি ডলার, অর্থাৎ মোট রপ্তানির প্রায় ৮৭ শতাংশ। এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য।
অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ হোসেন বলেন, “বাংলাদেশের জিডিপির এক বড় অংশই রপ্তানিনির্ভর। এখন যদি এই বাজারে প্রবৃদ্ধি থেমে যায় বা হ্রাস পায়, তাহলে সমগ্র অর্থনীতিতে ধীরগতি দেখা দেবে। রাজস্ব আয় কমবে, কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে এবং আমদানি ব্যয় ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে।”
বাণিজ্য বিশ্লেষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশ যদি সময়মতো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় বসে, তাহলে হয়তো শুল্ক কমানো বা কিছু পণ্যে ছাড় পাওয়া সম্ভব হতে পারে। সেটা না হলে, আমাদের ভবিষ্যৎ রপ্তানি রূপরেখা নতুনভাবে সাজাতে হবে।”
এদিকে জানা গেছে, ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ৯ জুলাই বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। অনেক রপ্তানিকারক, বিশেষজ্ঞ ও সরকারি কর্মকর্তাই এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছেন।
বাংলাবার্তা/এসজে