
ছবি: সংগৃহীত
বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, শ্রমিক অসন্তোষ এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশের অনিশ্চয়তার মধ্যেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এক অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। সদ্যসমাপ্ত এই অর্থবছরে দেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে ৯ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা পরিমাণে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৯ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই অর্জন দেশের রফতানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য এক দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা, যা সংকটের ভেতরেও স্থিতিশীলতা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই প্রবৃদ্ধির পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ। চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি কড়াকড়ি আরোপ এবং মার্কিন প্রশাসনের ‘চীন থেকে সরিয়ে নাও’ নীতির কারণে অনেক আন্তর্জাতিক ক্রেতা তাদের পোশাকের অর্ডার বিকল্প বাজারে স্থানান্তর করছে। এরই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোতে পোশাক রফতানির অর্ডার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্কের অবনতির কারণে মার্কিন ক্রেতারা কিছু অর্ডার অন্য দেশে স্থানান্তর করছে। এর একটা বড় অংশ বাংলাদেশ পাচ্ছে, যা রফতানিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।”
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নিটওয়্যার পণ্যে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই খাতে রফতানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, ওভেন পণ্যে ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে রফতানি হয়েছে ১৮ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এই দুই প্রধান খাতই দেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈচিত্র্যপূর্ণ ডিজাইন, সময়মতো সরবরাহ, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং অপ্রচলিত বাজারে প্রবেশের কারণে এই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে।
অর্থবছরের একটি বড় সময়জুড়ে দেশের প্রধান পোশাক উৎপাদন অঞ্চল ঢাকা, সাভার ও গাজীপুরে শ্রমিক অসন্তোষ ও আন্দোলনের ঘটনা ঘটলেও, গার্মেন্টস মালিকপক্ষ ও সরকার যৌথভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। বড় ধরনের সহিংসতা বা উৎপাদন বন্ধের ঘটনা ঘটেনি, যা রফতানি প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরামের চেয়ারম্যান এস এম আবু তৈয়ব বলেন, “আমরা যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প এখন যে কোনো ধরনের পণ্য উৎপাদনে সক্ষম, যার ফলে বিশ্বজুড়ে ক্রেতাদের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে।”
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির একটি বড় গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবছর দেশটি প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করে বাংলাদেশ থেকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতিতে যে পরিবর্তন এসেছে, তা রফতানিকারকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিজিএমইএ জানিয়েছে, ট্যারিফ জটিলতা কেটে গেলে এবং শুল্ক কাঠামো সহজ হলে আগামী অর্থবছরে রফতানি আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিজিএমইএর পরিচালক সাইফুল্লাহ মনসুর বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ট্যারিফ যৌক্তিক পর্যায়ে থাকলে আমরা সেখানে রফতানি আরও বাড়াতে পারবো। মার্কিন বাজার আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
রফতানি বাজারে বৈচিত্র্য আনতেও কাজ করছে বাংলাদেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর পাশাপাশি, ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ ও আফ্রিকার বেশ কিছু দেশেও এখন নিয়মিত রফতানি হচ্ছে তৈরি পোশাক। এই অপ্রচলিত বাজারগুলোতে প্রবেশ করেই দেশের পোশাক শিল্প বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যেও টিকে থাকার কৌশল রপ্ত করেছে।
বিজিএমইএর পরিচালক এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, “আমাদের সক্ষমতা আরও বাড়ছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ শুধু পোশাক রফতানির দিক থেকে নয়, মান ও বৈচিত্র্যেও বিশ্বে নেতৃত্ব দেবে। তবে এজন্য প্রয়োজন শুল্কনীতি, ব্যুরোক্রেসি এবং অবকাঠামোগত কিছু বাধা দূর করা।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, রফতানিতে এই প্রবৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান শ্রমিকদের। ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, কিছু আন্দোলন এবং নিরাপত্তা ইস্যুর মধ্যেও শ্রমিকরা নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। বিশেষ করে বিদেশি ক্রেতাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পোশাক সরবরাহ নিশ্চিত করতে উৎপাদন কখনও একেবারে বন্ধ হয়নি।
রফতানি আয়, প্রবৃদ্ধি ও বিশ্ব বাজারে অবস্থান—সব কিছু মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত সংকটের মাঝেও স্থিতিশীলতার নিদর্শন তৈরি করেছে। এখন প্রয়োজন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা, ট্যারিফ নিয়ে কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করা এবং উৎপাদন সক্ষমতা আরও বাড়ানো। তাহলেই এ শিল্প আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে, এবং ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি লক্ষ্যও দূরে থাকবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ