
ছবি: সংগৃহীত
টানা ভারি বৃষ্টিপাত ও ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা ফেনীতে। মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর তীব্র স্রোতে ইতোমধ্যেই জেলার তিনটি উপজেলা—ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। নদীভাঙনে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২১টি স্থান ধসে গিয়ে পানির তীব্র স্রোত জনবসতিতে ঢুকে পড়ায় কয়েক হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন।
একাধিক উপজেলার শতাধিক গ্রাম ইতোমধ্যে পানির নিচে তলিয়ে গেছে। নদীর পানি কিছুটা কমলেও ভাঙনস্থান দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করায় নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে প্রতি ঘণ্টায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বিপর্যস্ত ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার গ্রামগুলো। ছাগলনাইয়ায় অন্তত ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় অন্ধকারে রাত কাটাতে হচ্ছে, আর মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার জানান, বুধবার রাত ১১টার দিকে নদীর পানি বিপৎসীমার প্রায় ৩৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কিন্তু নদীর পানি কমার অর্থ এই নয় যে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বরং ইতোমধ্যে বাঁধে যে ২১টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে, সেখান দিয়ে প্রবল স্রোতে পানি প্রবেশ করায় নতুন নতুন গ্রাম ও শহরতলি প্লাবিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, পরশুরামে মুহুরী ও কহুয়া নদীর বাঁধে ১২টি এবং ফুলগাজীতে মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর বাঁধে ৯টি ভাঙনের স্থান চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র মুহুরী নদীতে ভাঙনের সংখ্যা ১১টি। এ তিন নদীর স্রোতে ফেনী জেলার অন্তত ১০০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
ফেনী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার কয়েকটি ইউনিয়নে বিদ্যুতের খুঁটি, মিটার ও ট্রান্সফরমার পানির নিচে চলে যাওয়ায় দুর্ঘটনা এড়াতে অন্তত ৩১ হাজার ২০০ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে। ফলে রাতভর অন্ধকারে কাটাতে হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের।
এদিকে প্লাবিত এলাকায় মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নদীর পানিতে ডুবে গেছে একাধিক মোবাইল টাওয়ার ও পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিট। অনেক এলাকায় মোবাইল ফোনে কথা বলা বা ইন্টারনেট ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন বহু মানুষ।
ছাগলনাইয়া উপজেলার গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে প্রবল স্রোতে বিভিন্ন গ্রামে পানি ঢুকতে শুরু করে। মুহূর্তেই গলা সমান পানি হয়ে যায়। কেউ কেউ নৌকা দিয়ে অন্যত্র সরে গেলেও, অনেকেই নিজ বাড়িতে আটকে পড়েছেন।
ভুক্তভোগী এক নারী বলেন, “ঘর থেকে বেরিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে পারিনি। বাড়িতে তিন দিন ধরে পানির মধ্যে আছি। বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ খোঁজও নেয়নি। খাবারও পাইনি।”
অপর একজন বৃদ্ধ জানান, “নদীতে পানি কমলেও বাঁধের ভাঙা জায়গা দিয়ে যা স্রোত বইছে, তা জীবনে দেখিনি। ধান-চাল যা ছিল সব পানিতে ভেসে গেছে। সন্তানদের নিয়ে কীভাবে বাঁচব বুঝতে পারছি না।”
বন্যার পানিতে ছাগলনাইয়া উপজেলার বেশ কয়েকটি সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ রয়েছে যান চলাচল। পরশুরাম ও ফুলগাজীর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দুর্ভোগে পড়েছে স্কুলগামী শিক্ষার্থী, কৃষক ও গৃহবন্দি নারী-শিশুরা।
আশ্রয়কেন্দ্রে সাত হাজারের বেশি মানুষ, ত্রাণ কার্যক্রম চলছে
জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জানান, ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদরের আংশিক অংশে মোট ৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে ইতোমধ্যে আশ্রয় নিয়েছে ৬ হাজার ৮২৬ জন মানুষ।
তিনি বলেন, “জেলার ছয় উপজেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে, যাতে দ্রুততম সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়।”
পরশুরাম ও ফুলগাজীতে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ৯০ জন স্বেচ্ছাসেবক উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে কাজ করছেন। ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবল চাকমা জানান, উপজেলা প্রশাসন সর্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছে। ৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তবে দুর্যোগের ভয়াবহতা যত দ্রুত ছড়াচ্ছে, তত দ্রুত সহায়তা পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান জানিয়েছেন, জেলায় গত তিন দিন ধরে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। বুধবার রাত ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, বৃহস্পতিবারও জেলাজুড়ে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকায় পানি নামার গতিও ধীর হয়ে পড়বে।
ফেনীর বন্যা পরিস্থিতি ঘিরে উদ্বেগ বাড়ছে পুরো অঞ্চলে। স্থানীয় প্রশাসন দ্রুত উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করলেও ক্ষতির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতির উন্নয়ন না ঘটলে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ