
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) প্রধান নির্বাচক ও দেশের প্রথম ওয়ানডে অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু সম্প্রতি বিতর্কিত এক মন্তব্যের জন্য প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের দল ঘোষণা উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, "যতদিন মিরাজ আছেন, ততদিন মোসাদ্দেকের সুযোগ নেই।" এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয় এবং প্রাক্তন ও বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
কিন্তু বুধবার (৯ জুলাই) শ্রীলঙ্কার পাল্লেকেলে স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচ চলাকালীন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে গাজী আশরাফ হোসেন স্পষ্ট করেন, তিনি আসলে কথাটি ভুলভাবে উপস্থাপন করেছিলেন এবং তার বক্তব্য ছিল ‘অপরিপূর্ণ ও ভুল শব্দচয়ন’ দ্বারা প্রভাবিত।
গাজী আশরাফ বলেন, “আমি অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ক্লান্ত ছিলাম। লাইভ ছিলাম, একেকজন একেক প্রশ্ন করছিল। সেই সময় একটা কথার মধ্যে আমি বলে ফেলি—‘যতদিন মিরাজ থাকবে, মোসাদ্দেকের সুযোগ নেই।’ পরে চট্টগ্রামে পৌঁছেই বুঝলাম, আমি ভুল করেছি। আমার বলা উচিত ছিল—‘যতদিন মিরাজ থাকবে, মোসাদ্দেকের সুযোগ অনেক কম।’ মাত্র তিনটি শব্দের এডজাস্টমেন্ট আমার বক্তব্যের প্রকৃত অর্থ বদলে দিত।”
তিনি আরও বলেন, “আমিও একসময় কলাম লিখতাম। জানি শব্দচয়ন কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই জায়গায় আমার বেখেয়ালি হয়েছে। তবে আমি বিষয়টা দ্রুত উপলব্ধি করেছি এবং মোসাদ্দেকের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমি তাকে নিজের ভুল ব্যাখ্যা করেছি। সরাসরি দুঃখ প্রকাশ করেছি। তাকে বলেছি, আমার উদ্দেশ্য এমন কিছু বলার ছিল না।”
প্রসঙ্গত, চলতি জুলাই মাসের শুরুতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের দল ঘোষণাকালে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘মোসাদ্দেককে কেন দলে রাখা হয়নি?’ জবাবে গাজী আশরাফ বলেন, “যত দিন মিরাজ থাকবে, ততদিন মোসাদ্দেকের সুযোগ নেই।” এই মন্তব্য দ্রুত ভাইরাল হয়ে পড়ে এবং অনেকেই এটিকে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।
বিশেষ করে, দুই খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্স তুলনা করে বিশ্লেষণ করা হয়—মোসাদ্দেক হোসেন অনেক ম্যাচেই মিডল অর্ডারে কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, আর মেহেদি হাসান মিরাজ মূলত ব্যাটিং অর্ডারে নিচের দিকে খেলে থাকেন, যদিও তিনি অলরাউন্ডার হিসেবে ধারাবাহিক। ফলে অনেকেই মনে করেন, তাদের ভূমিকা একেবারে একই নয়, এবং একজনের থাকার মানে আরেকজনের না থাকার অবস্থা তৈরি হওয়া যৌক্তিক নয়।
মোসাদ্দেক বিতর্ক ছাড়াও লিপু বাংলাদেশ দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স নিয়েও আলোচনা করেন। শ্রীলঙ্কার কাছে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হার নিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের পেসাররা লঙ্কানদের মতো ব্রেকথ্রু দিতে পারেনি। তারা মাঝের ওভারগুলোতে ম্যাচ বের করে নিয়েছে। আবার ব্যাটিংয়েও তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি গভীরতায় খেলেছে।”
তিনি যোগ করেন, “আমাদের ব্যাটসম্যানরা ভালো শুরু করেও ইনিংস লম্বা করতে পারেনি। তাদের মেন্ডিস ও আসালাঙ্কা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। আমাদের দলে এই জায়গায় একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা পূরণ করতে সময় লাগবে।”
গাজী আশরাফ আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার মতো খেলোয়াড়ের সংকট রয়েছে। আমাদের জাতীয় দল, ‘এ’ দল এবং হাই পারফরম্যান্স ইউনিট—এই তিন স্তরের মধ্যে প্রায় ৩০ জন খেলোয়াড়ের ওপরই আমরা নির্ভর করছি। নতুন খেলোয়াড় তুলে আনা ছাড়া বিকল্প নেই।”
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, “আমরা হাই পারফরম্যান্স প্রোগ্রামের ওপর জোর দিচ্ছি। এখান থেকে ভবিষ্যতের খেলোয়াড় বের হয়ে আসবে। কিছু তরুণ খেলোয়াড় উঠে আসছে, যারা আগামী দুই-তিন বছরে দলকে নেতৃত্ব দিতে পারবে।”
মোসাদ্দেক হোসেনকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসা গাজী আশরাফ হোসেন লিপু শেষ পর্যন্ত নিজের ভুল স্বীকার করে যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন, তা প্রশংসনীয়। জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচকের পদে থেকে এমন আত্মসমালোচনার দৃষ্টান্ত বিরল হলেও গুরুত্বপূর্ণ। তবে শুধু কথা নয়, ভবিষ্যতে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আরও স্বচ্ছতা, যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণ এবং খেলোয়াড়দের মর্যাদা রক্ষার দৃষ্টিভঙ্গিও যে জরুরি—এই বিতর্ক তা নতুন করে প্রমাণ করল।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে প্রতিভার সংকট নয়, সংকট যুক্তিসঙ্গত ব্যবহারের। সে দিকেই হয়তো এখন নজর দেওয়া সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ