
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যেন এক দীর্ঘ সময় ধরে থমকে থাকার প্রতিচ্ছবি। গত এক দশকেও একাধিক প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি, বারবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে এবং ব্যয় বেড়ে চলেছে। এই অবস্থা থেকে স্পষ্ট যে, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, জটিলতা এবং ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের ৩১টি চলমান প্রকল্পের মোট বরাদ্দ ১ লাখ ৩১ হাজার ৫০৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা, যার মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৮৩ হাজার ৬৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং সরকারের নিজস্ব তহবিল ৪৮ হাজার ৪৪৩ কোটি ৮ লাখ টাকা। এত বড় বাজেট থাকলেও প্রকল্পের অগ্রগতি দৃষ্টিগোচর হয় উদ্বেগজনক। কোনো প্রকল্পের কাজ ৮০ শতাংশ অতিক্রম করলেও অনেক প্রকল্পে কাজ মাত্র ৮ শতাংশ, আবার কিছু প্রকল্পের কাজ শুরুই হয়নি।
বিলম্বের কারণ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাব সবচেয়ে বড় কারণ। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের দুর্বলতা, মাস্টারপ্ল্যানের ত্রুটি, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা এবং বৈদেশিক দাতাগোষ্ঠীর অর্থ ছাড়ে অনিয়ম প্রকল্পগুলোতে বিলম্ব ঘটাচ্ছে। তদুপরি, পরামর্শক নিয়োগ ও দরপত্র প্রক্রিয়াকরণে বিলম্ব প্রকল্পের গতি কমিয়ে দিয়েছে।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ মিটারগেজ লাইনের পাশাপাশি ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ প্রকল্প এবং খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্প এর ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধির উদাহরণ। খুলনা-মোংলা প্রকল্পের নির্মাণকাজ ২০১০ সালে অনুমোদিত হলেও কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে, যা নির্মাণের জন্য নির্ধারিত তিন বছরের চেয়ে অনেক দেরি।
প্রকল্পের অগ্রগতি ও বরাদ্দ
২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মোট ৩১টি প্রকল্প রয়েছে, যার জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১০ হাজার ২২৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা। তবে মার্চ পর্যন্ত জাতীয় অগ্রগতি মাত্র ৩৬.৬৫ শতাংশ। কয়েকটি প্রকল্পের মেয়াদ তিনবার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে:
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প — বরাদ্দ ৩৮ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা।
যমুনা রেল সেতু নির্মাণ — ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা।
জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী সেকশনের ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ — ১৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।
দোহাজারী থেকে কক্সবাজার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ — ১১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম-দোহাজারী মিটারগেজ রেলপথকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর — ১০ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা।
ধীরাশ্রম আইসিডি নির্মাণ প্রকল্প — ৩ হাজার ৪০২ কোটি টাকা।
অন্য প্রকল্পগুলোরও বরাদ্দ কোটি কোটি টাকার মধ্যে।
মেয়াদ বৃদ্ধির বিশদ বিবরণ
পূর্বাঞ্চলের লেভেল ক্রসিং গেট পুনর্বাসন ও মান উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ তিনবার বাড়ানো হয়েছে।
খুলনা-মোংলা প্রকল্পের মেয়াদ তৃতীয় দফা বাড়ানো হয়েছে।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণের মেয়াদ একবার বাড়ানো হয়েছে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মেয়াদ দুইবার বাড়ানো হয়েছে।
জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী সেকশনের ডুয়েলগেজ নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ একবার বাড়ানো হয়েছে।
এ ছাড়া আরও বহু প্রকল্পের মেয়াদ এক বা একাধিকবার বৃদ্ধি পেয়েছে।
দায়িত্বশীলদের মত
পরিকল্পনা কমিশনের রেল পরিবহন শাখার উপপ্রধান মো. নাজমুল হাসান জানান, প্রকল্প বিলম্বের পেছনে ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যা, বৈদেশিক অর্থায়নের জটিলতা, যথাযথ যাচাই-বাছাই ও সমীক্ষার দুর্বলতা, বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতা রয়েছে। এসব কারণেই প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না।
রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) ফকির মো. মহিউদ্দিন বলেন, প্রতিটি প্রকল্পের নিজস্ব সমস্যা রয়েছে, যার জন্য কাজ শেষ করতে দেরি হচ্ছে। প্রকল্প পরিচালকরা বিলম্বের প্রকৃত কারণগুলো ভালোভাবে জানেন।
বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েট অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, “প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উপযোগিতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। নির্ধারিত সময়ের পরে কাজ শেষ হওয়ায় প্রকল্পের প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যায়নি।”
তিনি বলেন, “বাস্তবায়ন সংস্থা, পরামর্শক ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের মাঝে দায়বদ্ধতার অভাব প্রকল্পগুলোর ক্ষতি করছে। ভবিষ্যতে সঠিক পরিকল্পনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।”
বাংলাদেশ রেলওয়ের ৩১টি চলমান প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদী বিলম্ব ও ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃহৎ অর্থায়ন থাকা সত্ত্বেও জটিল প্রশাসনিক কার্যপ্রণালী, পরিকল্পনার ঘাটতি ও বাস্তবায়নের দুর্বলতার কারণে প্রকল্পগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থবির রয়েছে।
সরকারের উচিত এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা, প্রকল্প পরিচালনায় দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক সংস্কার আনা যাতে দেশ দ্রুত এবং কার্যকর রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতে পারে।
অবশ্যই সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা মিলে এই দীর্ঘস্থায়ী সংকটের অবসান ঘটাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এসজে