
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক ঘোষিত নতুন ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রভাব পড়তে চলেছে বাংলাদেশের বৃহত্তম শিল্প কেন্দ্র চট্টগ্রামের গার্মেন্টস খাতে, যা দেশের রপ্তানি আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষ করে, চট্টগ্রামের গার্মেন্টস শিল্পের প্রায় ৬০ শতাংশ কারখানা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর নির্ভরশীল। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শুল্ক আরোপের কারণে এসব কারখানার ক্রেতা হারানোর আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে একটি সংকটময় মোড় এনে দিতে পারে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীদের।
গত বছর বাংলাদেশের মোট রপ্তানি ৯ বিলিয়নের ওপর হলেও, এর প্রায় ৫ বিলিয়ন অর্থের পণ্য উৎপাদন করেছে চট্টগ্রামের গার্মেন্টস কারখানাগুলো। এই কারখানাগুলোর উৎপাদিত পণ্যের ৯৫ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। ক্লিফটন গ্রুপের কর্ণধার মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমাদের মোট রপ্তারির ৬০ শতাংশ চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যায়। যুক্তরাষ্ট্র যদি আমাদের পণ্য আমদানি আরও বাড়ায় এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমায়, তবে হয়তো তারা শুল্ক হার কমিয়ে দিতে পারে।”
তবে নতুন ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রেক্ষিতে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্রেতারা শুল্ক কম থাকা প্রতিযোগী দেশগুলোতে ঝুঁকবে, যার কারণে চট্টগ্রামের গার্মেন্টস কারখানাগুলো ব্যবসায়িক সংকটের মুখে পড়বে।
নাসিরাবাদের ফরচুন অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সালাম জানান, “গত বছর আমাদের রপ্তানি করা গার্মেন্টস পণ্যের পুরো ৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছে। কিন্তু আমাদের শুল্ক হার অন্য দেশের তুলনায় ১০-১৫ শতাংশ বেশি। এতে ক্রেতারা অন্য দেশে যাবে, যা চট্টগ্রামের জন্য বড় হুমকি।”
চট্টগ্রাম বন্দরনগরী হওয়ায় এ অঞ্চলের কারখানাগুলো দেশের রপ্তানিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাণ্ডারী হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে গার্মেন্টস শিল্প দেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি, তাই চট্টগ্রামের এই সংকট সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) এর তথ্যমতে, বিশ্বের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে প্রধান প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি গত বছর মাত্র ১ শতাংশেরও কম। অন্যদিকে, ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশের বেশি। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের পণ্যের জন্য ২০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করলেও বাংলাদেশের জন্য তা ৩৫ শতাংশ, যা বাংলাদেশের রপ্তানি সম্ভাবনাকে সংকীর্ণ করে দিচ্ছে।
ইন্ডিপেনডেন্ট অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম আবু তৈয়ব বলেন, “বর্তমান শুল্ক হার থাকলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনামের তুলনায় পিছিয়ে পড়বে এবং ক্রেতারা ভারত, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে চলে যাবে।”
বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়া, যারা উল্লেখযোগ্য হারে রপ্তানি বৃদ্ধি করছে। ২০২৪ সালে ভারতের তৈরি পোশাক রপ্তানি ছিল ১৬ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার, কম্বোডিয়ার ৯ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন, পাকিস্তানের ৯ দশমিক ২৮ বিলিয়ন এবং ইন্দোনেশিয়ার ৮ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। এই দেশগুলোর রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৬.৫%, ২৪%, ২১.৪% ও ৪.৬৭%, যা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি।
প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর জানান, “২০২৩ সালে তৈরি পোশাকের বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের অংশ ছিল ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে কমে ৬ দশমিক ৯০ শতাংশে নেমে এসেছে। এর বিপরীতে, ভিয়েতনামের অংশ বেড়ে ৬ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ হয়েছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে, বাংলাদেশ গার্মেন্টস খাতে বিশ্ববাজারে তার অবস্থান হারাতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “চট্টগ্রামে অবস্থিত অনেক প্রতিষ্ঠানই সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর নির্ভরশীল। শুল্ক হার পুনর্বিবেচনা না হলে এ প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এবং অনিবার্যভাবে কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”
অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ড. কাজল রহমান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক বাংলাদেশের রপ্তানিতে বড় ধরনের ধাক্কা। সরকারকে অবশ্যই দ্রুত কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে এই শুল্ক আরোপ থেকে কিছু ছাড় পাওয়া যায়।”
অন্যদিকে বাণিজ্য বিশ্লেষক সায়েম হোসেন মন্তব্য করেন, “চট্টগ্রামের কারখানাগুলোকে বৈচিত্র্যময় বাজার খোঁজার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। শুধুমাত্র মার্কিন বাজারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিশ্ববাজারে প্রবেশের নতুন পথ খুঁজতে হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে চট্টগ্রামের গার্মেন্টস শিল্পের জন্য সংকট দেখা দিয়েছে, যা দেশের অর্থনীতির বড় অংশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, সরকার দ্রুত বাণিজ্য কূটনীতি ও বাজার বৈচিত্র্যকরণে উদ্যোগ না নিলে, দেশের রপ্তানি খাত ধ্বংসাত্মক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। ফলে, চট্টগ্রামের গার্মেন্টস কারখানাগুলোকে সুরক্ষা দিতে এবং নতুন আন্তর্জাতিক বাজারের সন্ধানে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাবার্তা/এসজে