
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্থিতিশীলতার ওপর এক নতুন মাত্রার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশটির চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) জেনারেল অনিল চৌহান। তার মতে, চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ যখন নিজেদের কূটনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, তখন তা ভারতের নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করছে। সম্প্রতি নয়াদিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ORF) আয়োজিত এক উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব মন্তব্য করেন।
জেনারেল চৌহানের বক্তব্যে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় উদীয়মান ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন, যা ভারতীয় প্রতিরক্ষা পরিকল্পনায় নতুন করে সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
জেনারেল চৌহান বলেন, “ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ বর্তমানে অর্থনৈতিক চাপে রয়েছে। এই সংকট পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাচ্ছে কিছু বৈশ্বিক শক্তি, যারা নিজেদের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে এই দুর্বল দেশগুলোকে ব্যবহার করছে। বিশেষ করে ঋণ-কূটনীতির মাধ্যমে এ অঞ্চলে তৎপরতা বাড়িয়েছে চীন, যা ভারতের কৌশলগত ভারসাম্যকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই অঞ্চলের অনেক দেশের মধ্যে বারবার সরকার পরিবর্তন হচ্ছে। সেইসঙ্গে আদর্শগত অবস্থানেও পরিবর্তন আসছে। এসব বিষয় ভারতকে গভীর কৌশলগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে। এসব দেশ যখন একসঙ্গে মিলে নতুন ঘনিষ্ঠতার পথে হাঁটছে, তখন সেটি কেবল উদ্বেগজনকই নয়, ভারতীয় স্থিতিশীলতার জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।”
চৌহানের উদ্বেগের পেছনে রয়েছে একটি সাম্প্রতিক সম্মেলন যেখানে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা যৌথভাবে অংশ নিয়েছেন। তার মতে, “এই তিন দেশ নিজেদের স্বার্থে একে অন্যের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতা ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে কেবল রাজনৈতিক উদ্বেগ নয়, এটি একটি কৌশলগত হুমকি।”
তিনি বলেন, “তিন দেশের এমন একত্রতা যদি কৌশলগত ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার দিকে অগ্রসর হয়, তবে এটি ভারতের স্থিতিশীলতার ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিতে পারে। ভারতের চারপাশ ঘিরে যদি প্রতিদ্বন্দ্বী জোট তৈরি হয়, তবে তা কেবল সীমান্ত নয়, ভূ-মহাসাগরীয় অঞ্চলেও ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করবে।”
ভারত-পাকিস্তান সাম্প্রতিক সংঘাত প্রসঙ্গে চৌহান বলেন, “উত্তর সীমান্তে তেমন কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা না গেলেও, চীন ওই সংঘাতে পাকিস্তানকে কীভাবে সাহায্য করেছে, তা বলা কঠিন। তবে বাস্তবতা হলো, পাকিস্তান তাদের প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের বড় একটি অংশই চীন থেকে সংগ্রহ করে। ফলে সংঘাতের সময় চীনের সক্রিয় উপস্থিতি ছিল না বলার উপায় নেই।”
তিনি আরও বলেন, “চীনের এই সরাসরি অথবা পরোক্ষ সহায়তা ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। ভবিষ্যতে সংঘাতের সময় পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের যৌথ প্রস্তুতি ভারতের জন্য দ্বিগুণ চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।”
অনিল চৌহানের মতে, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের কৌশলগত প্রাধান্য টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই নতুন পরিকল্পনা নিতে হবে। “আমাদেরকে শুধু সামরিক শক্তি নয়, কূটনৈতিক সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ককে কেবল প্রতিযোগিতা নয়, অংশীদারিত্বের দিকে নিতে হবে—তবে নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “চীন যেভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়াচ্ছে, তাতে আগামী দশকগুলোতে ভারতের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বরাবরই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, কিন্তু এখন বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা ভারতকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।”
জেনারেল চৌহানের বক্তব্য ইতোমধ্যে ভারতের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষক রজত দত্ত বলেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক বরাবরই স্থিতিশীল ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেইজিং-ঢাকা ঘনিষ্ঠতা একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। এই ঘনিষ্ঠতা চীনকে বাংলাদেশের অবকাঠামো, প্রতিরক্ষা, এমনকি কূটনীতিতেও সরাসরি প্রবেশাধিকার দিচ্ছে।”
আরেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মঞ্জরী যোশী বলেন, “ত্রিদেশীয় ঘনিষ্ঠতার ধারণা ভারতের কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি যদি সত্যিকার অর্থেই প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতায় রূপ নেয়, তবে তা কেবল সীমান্ত নয়, ভারত মহাসাগরেও নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থার সূচনা করবে।”
চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ এবার সরাসরি প্রতিরক্ষা সর্বাধিনায়কের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো। অনিল চৌহানের এই বক্তব্য যে দক্ষিণ এশিয়ায় কূটনৈতিক উত্তেজনা ও কৌশলগত প্রতিযোগিতার এক নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য। সামনে ভারত কিভাবে এই ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ