
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার হয়েছে। যুদ্ধবিরতির সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো হোয়াইট হাউসে বৈঠক করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। মঙ্গলবার (৮ জুলাই) সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত এই অনির্ধারিত বৈঠকটি চলে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে, যেখানে কোনো গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার ছিল না।
এই গোপন বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়ও গাজা উপত্যকায় চলতে থাকে ইসরাইলের সামরিক অভিযান। ঠিক সেই মুহূর্তেই ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ৯৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন, যা কূটনৈতিক আলোচনার মধ্যেও যুদ্ধক্ষেত্রে সংঘর্ষ ও প্রাণহানি বন্ধ না হওয়ার প্রমাণ।
এর আগের দিন, অর্থাৎ সোমবার রাতে হোয়াইট হাউসে এক নৈশভোজের সময় ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু দীর্ঘসময় ধরে আলোচনায় বসেছিলেন। সেই বৈঠকের বিস্তারিতও প্রকাশ করা হয়নি। তবে দুই দিনের মধ্যে দুইবার এই ধরনের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক এটিই ইঙ্গিত করে যে, গাজা যুদ্ধ পরিস্থিতি ও যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে তীব্র আলোচনায় রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ নেওয়ার পর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর এটি তৃতীয় মার্কিন সফর, যা ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এবং গাজা পরিস্থিতির ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের গুরুত্বকেই তুলে ধরে।
বৈঠকের আগে দেওয়া এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, “আমাদের এর সমাধান করতে হবে। গাজা একটি ট্র্যাজেডি এবং আমিও এর অবসান চাই। আমার ধারণা, অপর পক্ষেরও একই অভিপ্রায় রয়েছে।” তার এই মন্তব্যে পরিষ্কার, ট্রাম্প প্রশাসন গাজা ইস্যুতে কূটনৈতিক সমঝোতার পথেই হাঁটতে চায়।
তবে মিডিয়ার অনুপস্থিতি এবং আলোচনার বিস্তারিত প্রকাশ না হওয়ায় ঠিক কী বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বা আলোচনা কতদূর অগ্রসর হয়েছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেতানিয়াহুর সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠকগুলো থেকে “খুব সামান্য তথ্যই” বাইরে এসেছে।
এই আলোচনার প্রেক্ষিতে আশাবাদী মন্তব্য করেছেন মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। তিনি ট্রাম্পের মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আশাবাদী যে এই সপ্তাহের শেষ নাগাদ আমরা একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে পারব, যার ফলে গাজায় ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে।”
তিনি আরও জানান, আলোচনার অংশ হিসেবে ১০ জন জীবিত জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং নয় জন নিহত জিম্মির মরদেহ ফেরত দেওয়া হবে। এই যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল যুদ্ধের ভয়াবহতা কিছুটা প্রশমনের পথে এগোচ্ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
যখন কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির পথ খোঁজা হচ্ছে, তখনই গাজার মাঠে ঘটছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর বৈঠকের সময় ইসরাইলি বাহিনীর বোমা হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৯৫ জন ফিলিস্তিনি। যুদ্ধবিরতির আলোচনা যতই এগোচ্ছে, বাস্তবতায় তা গাজাবাসীদের দুর্ভোগ কমাতে তেমন ভূমিকা রাখছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলকে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে আসছেন। ২০১৭ সালে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি, পশ্চিম তীরের অবৈধ বসতি স্থাপন বৈধতা দেওয়ার প্রক্রিয়া—সবকিছুই নেতানিয়াহু সরকারের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের রাজনৈতিক ঐক্যকে স্পষ্ট করে তোলে।
তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। গাজায় দীর্ঘদিন ধরে চলা যুদ্ধ, লক্ষাধিক মানুষের বাস্তুচ্যুতি, মানবিক সহায়তার ঘাটতি এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ট্রাম্প প্রশাসন কিছুটা নমনীয় কূটনৈতিক অবস্থান নিতে বাধ্য হচ্ছে।
গাজা পরিস্থিতি এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে একদিকে রয়েছে কূটনৈতিক সমঝোতার আলো, অন্যদিকে নির্মম হত্যাযজ্ঞের বাস্তবতা। ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়িত হলে তা সাময়িক হলেও কিছুটা স্বস্তি নিয়ে আসবে গাজাবাসীদের জন্য। তবে অনেকেই মনে করেন, এই যুদ্ধবিরতি যদি দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক সমাধানে না গড়ায়, তাহলে তা হবে কেবল সময়ক্ষেপণের একটি কৌশল।
গাজা সংকটের সমাধান খুঁজতে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর মধ্যে একের পর এক বৈঠক এটাই প্রমাণ করে—দুই দেশই এখন কিছু একটা পরিবর্তনের প্রয়োজনে একমত। যুদ্ধবিরতির আলোচনার পেছনে কূটনৈতিক এবং মানবিক চাপ সমানভাবে কাজ করছে। তবে সমঝোতা কতটা কার্যকর হবে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের বাস্তব দুর্ভোগ কতটা লাঘব হবে, তা নির্ভর করছে সামনের দিনগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও বাস্তবায়নের ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ