
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে করা মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি মো. গোলাম মোর্তোজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক বেঞ্চ এই অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন। এর মধ্য দিয়ে পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হল, যা রাজনৈতিক ও আইনি অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে।
এই মামলায় বিচার শুরু হওয়াকে একটি ঐতিহাসিক ধাপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অনেকে। কারণ, এটি এমন এক প্রক্রিয়ার সূচনা, যেখানে এক সময়কার ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার শুরু হচ্ছে।
মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া গণবিক্ষোভ ও গণঅভ্যুত্থানের সময় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে সংঘটিত একাধিক হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও নিখোঁজের ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় পড়ে।
এই অপরাধগুলোর পেছনে মূল নির্দেশদাতা ও কৌশল নির্ধারক হিসেবে শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের নাম উঠে আসে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।
বিচারপতি মোর্তোজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ৩ আগস্ট দিন নির্ধারণ করেছে।
এই দিনে রাষ্ট্রপক্ষ প্রথম সাক্ষী উপস্থাপন করবে এবং মামলার প্রাথমিক সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ শুরু হবে। রাষ্ট্রপক্ষ জানিয়েছে, তাদের কাছে চোখে দেখা প্রত্যক্ষদর্শী, ভিডিও ফুটেজ, সরকারি আদেশের নথি, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনসহ গুরুত্বপূর্ণ সব ধরনের তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, যেগুলোর ভিত্তিতে তারা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবে বলে আশাবাদী।
এই মামলার বিচার কাজ পরিচালনা করছেন ট্রাইব্যুনালের তিন সদস্য: বিচারপতি মো. গোলাম মোর্তোজা মজুমদার (সভাপতি), বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ, এবং বিচারক মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
আসামিদের মধ্যে একমাত্র চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন এবং অভিযোগ গঠনের দিন আদালতে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনা ও কামাল মামলায় পলাতক অবস্থায় রয়েছেন বলে রাষ্ট্রপক্ষ জানায়।
তবে তাদের বিরুদ্ধে আগেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের প্রত্যার্পণের চেষ্টাও চলছে বলে জানা গেছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সরকারবিরোধী গণআন্দোলনের সময় সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে বহু সাধারণ নাগরিক নিহত হন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, শুধু ওই দুই মাসে দেশের বিভিন্ন শহরে অন্তত ৭৩ জন নিহত ও ৫০০ জনের বেশি আহত হন, যার মধ্যে বেশ কয়েকজন শিশু, নারী ও সাংবাদিকও ছিলেন।
এই ঘটনাগুলো নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। দেশীয় মানবাধিকার সংগঠন ছাড়াও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা, জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই ঘটনাগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার দাবি করে।
জনমতের চাপের মুখে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ নেয়।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট রফিকুল হোসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “আজকের দিনটি বাংলাদেশের বিচার ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। আমরা আশা করি, অপরাধীদের যে-ই হোক, আইনের মুখোমুখি হতে হবে। বিচার অবশ্যম্ভাবী।”
আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার তাহমিনা হক বলেন, “রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক, যদি সত্যি প্রমাণ হয় যে রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহারে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, তাহলে সে অপরাধীদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আসা উচিত।”
এই মামলা আন্তর্জাতিক মহলেও নজর কাড়ছে। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো একজন প্রভাবশালী নেত্রীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হওয়াকে অনেকেই আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছেন।
জাতিসংঘের বিশেষ মানবাধিকার প্রতিনিধি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সরকারের কাছে মামলার অগ্রগতির নিয়মিত আপডেট চেয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিছু পর্যবেক্ষক দল আগামী মাসেই বাংলাদেশ সফরে এসে বিচার প্রক্রিয়া সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করতে পারে বলেও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরুর মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় সূচিত হয়েছে। এটি যেমন একটি আইনগত বিজয়, তেমনি দেশের বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও সক্ষমতারও এক ধরনের প্রমাণ।
তবে এই বিচার কতটা স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরিচালিত হয়, তা নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতে এই প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা। সব মিলিয়ে, এই মামলা এখন শুধু আইনি প্রক্রিয়াই নয়, রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকও।
বাংলাবার্তা/এমএইচ