
ছবি: সংগৃহীত
গাজার রক্তক্ষয়ী সংঘাত থামাতে বহু প্রত্যাশিত দুই দফা বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউজে অনুষ্ঠিত হয় এই বৈঠক দুটি, যেখানে বিশ্ববাসী আশা করেছিল অন্তত একটিবারের জন্য হলেও আসবে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা, দেখা দেবে শান্তির আভাস। কিন্তু ফলাফল শূন্য। যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হলো আলোচনার এই পর্ব, যার ফলে হতাশা আরও ঘনীভূত হলো আন্তর্জাতিক মহলে।
মঙ্গলবার (৯ জুলাই) রাতে দ্বিতীয়বারের মতো হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসেন নেতানিয়াহু। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলে এই আলোচনা। বৈঠক শেষে কোনো বিবৃতি বা যৌথ সংবাদ সম্মেলন ছাড়াই হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী। এর আগের দিন সোমবার রাতে ট্রাম্পের সঙ্গে নৈশভোজের সময়ও দীর্ঘ আলোচনা হয় বলে জানা যায়।
বৈঠকের আগে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, “গাজার পরিস্থিতি একটি ট্র্যাজেডি। আমরা এর সমাধান চাই এবং আমি বিশ্বাস করি অন্য পক্ষও তাই চায়।” যদিও এ ধরনের মানবিক মন্তব্য শোনালেও শেষ পর্যন্ত আলোচনায় কোনো কার্যকর ফল আসেনি। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, আলোচনার বেশিরভাগ বিষয় ছিল গোপন এবং বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভেন উইটকফ দাবি করেছেন, “যুদ্ধবিরতির একটি চুক্তির কাছাকাছি আমরা পৌঁছেছি। আশা করছি, সপ্তাহের শেষ নাগাদ একটি ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি চুক্তি হবে, যাতে অন্তত ১০ জন জীবিত জিম্মি ও ৯ জন নিহত ফিলিস্তিনির মরদেহ ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে।”
তবে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নিয়ে এতটা আশাবাদী নয় কাতার। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি মঙ্গলবার বলেন, “আমরা এখনই নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা দিতে পারছি না। আরও সময় লাগবে। আলোচনা চলবে বহুদিন।”
এদিকে সৌদি সংবাদমাধ্যম আশরাক নিউজ জানিয়েছে, দোহায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে পাঁচ দফা আলোচনার সাম্প্রতিক পর্বটিও গুরুত্বপূর্ণ কোনো অগ্রগতি ছাড়াই শেষ হয়েছে। এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা জানান, “ইসরাইলি প্রতিনিধিদল মূলত কেবল শুনেছে, আলোচনায় সক্রিয় ভূমিকা নেয়নি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের ছিল না। বাস্তবে সব সিদ্ধান্তই নেতানিয়াহুর একক ইচ্ছাধীন।”
সেই সঙ্গে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে নেতানিয়াহুর ঘোষিত পরিকল্পনা। তিনি গাজার সব ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণাঞ্চলে একটি ঘেরাও করা শিবিরে পাঠাতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেন, “রাফার ধ্বংসস্তূপের ওপর একটি ‘মানবিক শহর’ গড়ে তোলা হবে, যেখানে প্রাথমিকভাবে ছয় লাখ ফিলিস্তিনি রাখা হবে। যাদের হামাস সংশ্লিষ্টতা নেই, কেবল তারাই সেখানে ঢুকতে পারবে।”
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এটি একটি ‘নতুন ধরনের বন্দিশিবির’ যেখানে ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে এবং এ পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে।
টানা আলোচনা চললেও গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলা থেমে নেই। মঙ্গলবার রাতে খান ইউনুস এবং গাজার উত্তরের একটি শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি হামলায় অন্তত ২০ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে ছয়জন শিশু ছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫ জনে। এই নিয়ে গাজায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৫৭ হাজার ৫৭৫ জনে পৌঁছেছে। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ৩৬ হাজার ৮৭৯ জন।
জাতিসংঘের মতে, বর্তমানে গাজা বিশ্বের সবচেয়ে বিপর্যস্ত মানবিক সংকটময় অঞ্চল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পানি ও খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা—সবকিছুই প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই যুদ্ধবিরতি আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে নেতানিয়াহুর এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ইসরাইলি কেবিনেট বা সমন্বয়কারী দল কোনো স্বচ্ছ পরিকল্পনা নিয়ে আসেনি। এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনও এখনও মানবিক যুদ্ধবিরতির চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে।
ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, তুরস্ক, মিসর, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হোয়াইট হাউজের এই বৈঠক থেকে একটি যুদ্ধবিরতির আশা করেছিল। কিন্তু নেতানিয়াহু-ট্রাম্প বৈঠক শেষ পর্যন্ত আরেকটি ‘কূটনৈতিক ফটোসেশন’ হয়েই থেকে গেল।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা আশা করেছিলাম, আলোচনার মাধ্যমে কমপক্ষে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত হবে। তবে দুঃখজনকভাবে, সেই আশা এখনো অপূর্ণ।”
সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, গাজা সংকটে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল এখনো কার্যকর শান্তি প্রতিষ্ঠায় সম্মত হতে পারেনি। যুদ্ধবিরতির বার্তা না আসা মানে আরও ধ্বংস, আরও মৃত্যু। হোয়াইট হাউজে বৈঠকের পরও গাজাবাসীর জীবনে পরিবর্তনের কোনো আভাস নেই। এখন প্রশ্ন উঠেছে—এই আলোচনার অর্থ কী, যদি তা বাস্তবতায় কোনো মানবিক বার্তা দিতে না পারে? বিশ্ব আবারও হতাশ হলো; আর গাজার আকাশে শান্তির সূর্য এখনো ওঠেনি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ