
ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বাক্ষরিত সাম্প্রতিক অভিবাসন আইন ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’-এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ, শিক্ষাগ্রহণ ও কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে যাওয়া বাংলাদেশিসহ বিশ্বের নানা দেশের নাগরিকদের জন্য বাড়তি ব্যয় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৪ জুলাই (২০২৫) স্বাক্ষরিত এই আইনের আওতায় নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসার ওপর নতুন করে ‘ভিসা ইন্টেগ্রিটি ফি’ নামে ২৫০ মার্কিন ডলারের একটি অতিরিক্ত চার্জ আরোপ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশি আবেদনকারীদের জন্য মার্কিন ভিসা পেতে ব্যয় বাড়াবে আড়াই গুণেরও বেশি।
মার্কিন কংগ্রেসে পাস হওয়া এবং প্রেসিডেন্টের সই পাওয়া এই বিস্তৃত বিলটির আওতায় শুধু ভিসা ফি-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপরও নতুন আবগারি শুল্ক যুক্ত করা হয়েছে। আইনটি কার্যকর হওয়ার পর প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে টাকা পাঠাতে গেলে প্রতিটি লেনদেনে ১ শতাংশ হারে কর পরিশোধ করতে হবে, যা এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের জন্য একটি বড় আর্থিক ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই ফি মূলত একটি নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ হিসেবে চালু করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মতে, অনেক বিদেশি ভিসাধারী ভিসার শর্ত ভঙ্গ করে দেশটিতে দীর্ঘদিন অবস্থান করছেন বা অবৈধভাবে কাজ করছেন। এই প্রবণতা রোধে নতুন ‘ভিসা ইন্টেগ্রিটি ফি’ বা নিরাপত্তা জামানত আরোপ করা হয়েছে। এটি ২০২৬ সাল থেকে কার্যকর হবে এবং অধিকাংশ নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসা ক্যাটাগরিতে প্রযোজ্য হবে।
এই ফির আওতায় পড়বে:
B-1/B-2 ভিসা: ব্যবসায়িক ও পর্যটন ভিসা
F ও M ভিসা: শিক্ষার্থী ও পেশাগত প্রশিক্ষণের জন্য
H-1B ভিসা: বিদেশি কর্মীর জন্য
J ভিসা: এক্সচেঞ্জ ভিজিটরদের জন্য
তবে কূটনৈতিক উদ্দেশ্যে দেওয়া ‘A’ ও ‘G’ শ্রেণির ভিসাধারীরা এই ফির বাইরে থাকবেন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পর্যটন বা ব্যবসায়িক (B-1/B-2) ভিসার জন্য একজন বাংলাদেশিকে গড়ে ১৮৫ মার্কিন ডলার (প্রায় ২২,২০০ টাকা) ফি দিতে হয়। নতুন ‘ভিসা ইন্টেগ্রিটি ফি’ (২৫০ ডলার), আই-৯৪ ফি (২৪ ডলার), ও ইলেকট্রনিক ট্রাভেল অথরাইজেশন ফি (১৩ ডলার) যোগ হলে মোট খরচ দাঁড়াবে প্রায় ৪৭২ ডলার, অর্থাৎ ৫৬ হাজার ৬৪০ টাকা, যা বর্তমান খরচের প্রায় আড়াই গুণ।
শুধু পর্যটক নয়—যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা নিতে আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রেও এই ফি লাগু হবে। এফ (F) বা এম (M) ক্যাটাগরির ভিসার জন্যও এই বাড়তি খরচ গুনতে হবে। তেমনি এইচ-১বি (H-1B) ক্যাটাগরির পেশাজীবীরাও বাড়তি এই ফির আওতায় পড়বেন, ফলে যুক্তরাষ্ট্রে কাজের জন্য যাওয়ার খরচও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।
এই ফি সাধারণভাবে অফেরতযোগ্য, তবে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করলে তা ফেরত পাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। যেমন: ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার ৫ দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করা হলে, বৈধভাবে স্ট্যাটাস পরিবর্তন বা মেয়াদ বৃদ্ধি করলে, গ্রিন কার্ড পাওয়ার মতো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে।
তবে যদি কোনো ভিসাধারী শর্ত লঙ্ঘন করেন বা নির্ধারিত সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ না করেন, সেক্ষেত্রে এই ফি ফেরত দেওয়া হবে না। অর্থাৎ, এটি কার্যত এক ধরনের নিরাপত্তা আমানত যা বিদেশিদের ভিসার শর্ত পালনে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছে।
নতুন আইন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত অভিবাসীরা তাদের নিজ দেশে রেমিট্যান্স পাঠালে প্রতি লেনদেনে ১ শতাংশ করে আবগারি শুল্ক (Excise Tax) পরিশোধ করতে হবে। ধরুন, একজন প্রবাসী বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১ হাজার ডলার দেশে পাঠাচ্ছেন, তাহলে তাকে অতিরিক্ত ১০ ডলার কর দিতে হবে।
মার্কিন প্রশাসন বলছে, এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে অভিবাসী কর্মীদের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এতে শুধু প্রবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যেতে পারে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে রেমিট্যান্স একটি প্রধান উৎস, ফলে এই সিদ্ধান্তের অর্থনৈতিক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের হতে পারে।
‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ নামে পরিচিত এই আইনটি ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিলটির মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৯০০-এর বেশি এবং এতে আরও বেশ কিছু কড়াকড়ি নিয়মের কথা উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে অবৈধ অভিবাসীদের ওপর নজরদারি বৃদ্ধি, সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদারকরণ, এবং যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত বিদেশিদের ওপর বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক বিধি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এই নতুন নিয়মগুলো কার্যকর হলে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থী, প্রযুক্তি কর্মী, পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াত অনেক বেশি ব্যয়বহুল ও জটিল হয়ে পড়বে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিশ্লেষকেরা। বিশেষ করে যারা সীমিত বাজেট ও স্কলারশিপের ওপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা নিতে চান, তাদের জন্য এই ফি একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ, পড়াশোনা বা কাজের উদ্দেশ্যে যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশিদের জন্য আগামী বছরগুলোতে বাড়তি খরচ ও কড়াকড়ির বাস্তবতা মোকাবিলা করেই এগোতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকেও এই বিষয়ে কূটনৈতিকভাবে আলোচনার সম্ভাবনা তৈরি করা জরুরি, বিশেষত রেমিট্যান্স সংক্রান্ত আবগারি শুল্কের বিষয়ে। অন্যদিকে, সম্ভাব্য আবেদনকারীদের এখন থেকেই এই বাড়তি ব্যয় মাথায় রেখে পরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ