
ছবি: সংগৃহীত
যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকলেও ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না। বরং সেই আলোচনা চলার মাঝেই ভয়াবহভাবে বেড়েছে ইসরাইলি হামলার তীব্রতা। গত বৃহস্পতিবার ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ইসরাইলি বাহিনীর চালানো ধারাবাহিক বিমান ও স্থল হামলায় একদিনেই প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮২ জন ফিলিস্তিনি। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন শিশু, নারী ও বৃদ্ধ।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ শহরে। সেখানে শিশুখাদ্য ও ত্রাণ সংগ্রহের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় একসঙ্গে নিহত হন ১৫ জন ফিলিস্তিনি। এই হামলায় নিহতদের মধ্যে ৯ জনই শিশু এবং ৪ জন নারী। এছাড়া গুরুতর আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৩০ জন, যাদের মধ্যে ১৯ জন শিশু।
স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সকালে এই হামলা চালানো হয়, যখন মানুষ খাদ্যের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা গেছে, ত্রাণ বহনকারী ট্রাকগুলো তখনো ঘটনাস্থলে পৌঁছায়নি, অথচ এর আগেই বিমান থেকে বোমা ফেলা হয়। ঘটনাস্থলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্তাক্ত কাপড়, খাদ্যের প্যাকেট ও শিশুর খেলনা নৃশংসতার সাক্ষ্য দিচ্ছিল।
ঘটনার নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেন, "মানুষ যখন শুধুমাত্র বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সাহায্য নিতে যাচ্ছে, তখন তাদের হত্যা করা একেবারেই অমানবিক।"
তিনি আরও বলেন, "গাজায় দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছায়নি। এর ফলে হাজার হাজার শিশু আজ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে এবং দুর্ভিক্ষের হুমকি ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে। এই হামলা মানবতার পরিপন্থী।"
তিনি ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে চলার আহ্বান জানান এবং এ ধরনের হামলার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেন।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস এক বিবৃতিতে এই হত্যাকাণ্ডকে 'গাজায় চলমান গণহত্যার ধারাবাহিকতা' বলে উল্লেখ করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, "ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে শিশু, নারী ও সাধারণ মানুষকে টার্গেট করছে। স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট ও শরণার্থী শিবিরে ধারাবাহিকভাবে হামলা চালিয়ে এটি একটি পরিকল্পিত জাতিগত নিধনের রূপ নিয়েছে।"
তারা আরও দাবি করে, ইসরাইল এই গণহত্যা চালাচ্ছে বিশ্বের চোখের সামনেই, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা এই নৃশংসতাকে উৎসাহ দিচ্ছে।
এই প্রাণহানির ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটলো, যখন গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময় নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা চলছে।
একইসঙ্গে, দক্ষিণ গাজার রাফাহ এলাকায় ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তর নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আশঙ্কা, ইসরাইল যুদ্ধবিরতির অজুহাতে রাফাহ থেকে বেসামরিক লোকজনকে জোরপূর্বক বের করে দিয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় আছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার প্রতিশোধে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় যে সামরিক অভিযান শুরু করে, তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ওই দিন হামাসের হামলায় ১২০০ ইসরাইলি নিহত হন এবং প্রায় ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। এর পর থেকেই গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর প্রতিশোধপরায়ণ সামরিক অভিযান ভয়াবহ রূপ নেয়।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৫৭ হাজার ৭৬২ জন ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন ১ লাখ ৩৭ হাজার ৬৫৬ জনের বেশি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই নারী ও শিশু, যা আন্তর্জাতিক মহলে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।
এই হামলার পরপরই জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। ফ্রান্স, তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার মামলা চলমান রাখার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে।
গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনার মধ্যেই ইসরাইলের ভয়াবহ হামলা আবারও প্রমাণ করলো—এই সংঘাত শুধুমাত্র দুই পক্ষের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং একটি গুরুতর মানবিক বিপর্যয়। প্রতিদিনের নতুন লাশের মিছিলে শিশুদের মৃত্যু যেন কেবল পরিসংখ্যান নয়, বরং গোটা মানব সভ্যতার বিবেকের উপর এক সরাসরি আঘাত।
এই সহিংসতা কবে থামবে, তা এখনও অনিশ্চিত। তবে একদিনে ৮২ প্রাণ ঝরে যাওয়ার এই মর্মান্তিক ঘটনাটি যুদ্ধবিরতির আলোচনার পটভূমিতে ভয়াবহ বার্তা দিয়েছে—যেখানে আলোচনার টেবিলে আশার প্রদীপ জ্বললেও, মাটিতে পড়ে রয়েছে অসংখ্য নিষ্পাপ প্রাণের নিথর দেহ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ