
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব প্রদান নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া বিতর্কিত পদক্ষেপ আবারও আইনি বাধার মুখে পড়েছে। নিউ হ্যাম্পশায়ারের একটি ফেডারেল আদালত ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ কার্যকরের ওপর সাময়িক স্থগিতাদেশ জারি করেছে। এর ফলে ২৭ জুলাই থেকে যে আদেশটি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল, তা আপাতত স্থগিত হয়ে গেল। এই আদেশে যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া শিশুদের নাগরিকত্ব বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, বিশেষ করে যাদের পিতামাতা অবৈধ অভিবাসী বা ভিসা ছাড়া অবস্থানকারী।
নিউ হ্যাম্পশায়ারের আদালতের বিচারক এই মামলাকে ক্লাস অ্যাকশন বা প্রতিনিধিত্বমূলক মামলা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, যার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া হাজারো শিশুর নাগরিকত্ব ঝুঁকিতে পড়তে পারত। আদালতের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ট্রাম্পের আদেশটি “অসাংবিধানিক ও ক্ষতিকর”, বিশেষ করে শিশুদের মৌলিক অধিকার হরণ করে এমন নীতির বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের বৈধতা রয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মামলাটি এখন থেকে সকল ক্ষতিগ্রস্ত শিশু ও তাদের পরিবারকে প্রতিনিধিত্ব করবে এবং আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করবে একটি বৃহত্তর আইনি কাঠামোর মাধ্যমে।
এই মামলা দায়ের করেছে অভিবাসী অধিকার সংগঠন আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (ACLU)। সংগঠনটি জানায়, ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশটি সরাসরি সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর লঙ্ঘন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী, কোনো শিশু দেশটির ভূমিতে জন্ম নিলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমেরিকার নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি—এই অধিকার সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বিশেষত যেসব শিশুর বাবা-মা অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
এসিএলইউর মতে, এই নীতির ফলে অসংখ্য পরিবারকে বিচ্ছিন্নতা, হয়রানি এবং আইনি জটিলতার মুখে পড়তে হবে। তাছাড়া, এ ধরনের পদক্ষেপ দেশের দীর্ঘদিনের নাগরিকত্ব নীতির পরিপন্থী।
অবশ্য এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট একাধিকবার জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব রক্ষার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু এবার মামলাটি ভিন্ন কাঠামোয় উপস্থাপিত হয়েছে। আদালতে ক্লাস অ্যাকশন মামলার ব্যতিক্রমী বিধান প্রয়োগ করে আইনজীবীরা মামলা চালিয়ে নেওয়ার অনুমতি পেয়েছেন। বিশ্লেষকদের মতে, এ সিদ্ধান্ত শুধু এই মামলার জন্য নয়, ভবিষ্যতের অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
যদিও আদালতের এই স্থগিতাদেশ ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা, তবে আদালত সরকারের জন্য ৭ দিনের একটি সময়সীমা নির্ধারণ করেছেন—এই সময়ের মধ্যে সরকার চাইলে উচ্চতর আদালতে আপিল করতে পারবে।
ট্রাম্পপন্থী আইনজ্ঞদের দাবি, আদালতের এই রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অভিবাসন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ও মানবিক মূল্যবোধ রক্ষায় একটি বিজয়।
২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট থাকার সময় থেকেই ট্রাম্প “জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব” প্রথা বিলুপ্তির পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময় বলেছেন, “ভূমির ওপর জন্ম নিলেই নাগরিকত্ব পাওয়ার নিয়ম অনৈতিক এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ায়।” সেই সময়েও তার প্রশাসন নাগরিকত্ব আইনে পরিবর্তনের পদক্ষেপ নেয়, যদিও আইনি বাধায় তা বাস্তবায়ন করা যায়নি।
২০২৫ সালে আবারও ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় এসে এই নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে পূর্বের উদ্যোগকে কার্যকর করার চেষ্টা করে। তবে একাধিক ফেডারেল আদালত এই আদেশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দেন। এবারের নিউ হ্যাম্পশায়ার আদালতের আদেশ সেই ধারারই আরও শক্তিশালী ও আইনি কাঠামোবদ্ধ একটি উদাহরণ হয়ে উঠলো।
এখন প্রশ্ন হলো—আদালতের এই সিদ্ধান্ত কতটা স্থায়ী হবে এবং সুপ্রিম কোর্ট বা আপিল আদালতে এর ভবিষ্যৎ কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব যুক্তরাষ্ট্রের মূল আইনি কাঠামোর অন্যতম ভিত্তি। যদি ট্রাম্পের আদেশ চূড়ান্তভাবে বৈধতা না পায়, তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাও কঠিন হয়ে পড়বে।
ট্রাম্প প্রশাসনের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের উদ্যোগ বারবার আইনি বাধায় আটকে যাচ্ছে। নিউ হ্যাম্পশায়ার আদালতের এই সর্বশেষ রায় যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া লক্ষাধিক শিশুর জন্য তাৎপর্যপূর্ণ এবং আশার বার্তা। নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে এই রায় নতুন এক আইনি অধ্যায়ের সূচনা করেছে—যেখানে সংবিধান, মানবাধিকার এবং রাষ্ট্রের নৈতিক দায়বদ্ধতা মুখোমুখি হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, ভবিষ্যতে উচ্চ আদালতে এই মামলার ফলাফল কী দাঁড়ায়, এবং তা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নীতিতে কী পরিবর্তন আনে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ