
ছবি: সংগৃহীত
ভিটামিন ডি শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পুষ্টি উপাদান, যা মূলত হাড় মজবুত রাখার পাশাপাশি শরীরের নানা প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পা, কোমর, কিংবা পিঠে ব্যথার সঙ্গে ভিটামিন ডির অভাব জড়িত থাকতে পারে — তবে শুধু ব্যথা নয়, এর অভাব শরীরে আরও অনেক মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে, যা আমরা সচরাচর ভেবে থাকি না।
ভিটামিন ডি মূলত ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে, যা হাড়কে শক্তিশালী করে। খাদ্য থেকে শোষিত ক্যালসিয়ামের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতেই ভিটামিন ডি অপরিহার্য। যখন শরীরে ভিটামিন ডির পরিমাণ কমে যায়, তখন হাড় ভঙ্গুর হয়ে যায়, যার ফলে হাড়ে ব্যথা শুরু হয় এবং মাংসপেশির দুর্বলতা দেখা দেয়। এই কারণে পা ও কোমরে ব্যথা, পিঠের কষ্ট অনুভূত হতে পারে। বিশেষ করে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যা বৃদ্ধি পায়।
ইংল্যান্ডের বৈজ্ঞানিক পত্রিকা ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্ট’-এ ২০২৪ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শহর ও গ্রামীণ এলাকায় প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ভিটামিন ডির ঘাটতির মাত্রা অত্যন্ত উদ্বেগজনক—প্রায় ৯১.২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে ভিটামিন ডির অভাব রয়েছে, আর পঞ্চাশের ওপর বয়সীদের ক্ষেত্রে এই হার পৌঁছে ৯৪ শতাংশে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বা পরিবেশগত কারণে এমন অভাব আরও প্রকট হতে পারে।
শরীরের শর্করার নিয়ন্ত্রণে ভিটামিন ডির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভিটামিন ডির অভাব হলে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে বিঘ্ন ঘটতে পারে, যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ২০১৮ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে রক্তে গ্লুকোজের ওঠাপড়া নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তাই ডায়াবেটিসের রোগীদের ভিটামিন ডি পর্যাপ্ত মাত্রায় নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভিটামিন ডি মেজাজ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, কারণ এটি সেরোটোনিন নামক সুখানুভূতি জোগানো নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রাকে প্রভাবিত করে। যখন ভিটামিন ডির মাত্রা কমে যায়, তখন সেরোটোনিনের নিঃসরণ কমে, যার ফলে অবসাদ, হতাশা এবং ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘ সময় ধরে ভিটামিন ডির ঘাটতি থাকলে তা বিষণ্ণতা এবং অবসাদগ্রস্ত মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে।
শুধু পা বা কোমরের ব্যথা নয়, ভিটামিন ডির অভাব বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বিশেষ করে কোলোরেক্টাল (বৃহদান্ত্র ক্যানসার), স্তন ক্যানসার এবং প্রস্টেট ক্যানসারের সঙ্গে এর সম্পর্ক গবেষণায় উঠে এসেছে। ২০১৫ সালে ‘এমডিপিআই’ নামক জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, ক্যানসার চিকিৎসায় ভিটামিন ডির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে এবং এটি রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
ডা. লাইলী রহমান, একজন পুষ্টিবিদ, বলেন, “ভিটামিন ডি’র অভাব আমাদের দেশে ব্যাপক। অনেকেই তার লক্ষণ বুঝতে পারছেন না। শুধু পা বা কোমরে ব্যথা নয়, সার্বিক স্বাস্থ্য রক্ষায় ভিটামিন ডি অপরিহার্য। রোজ একটু সময় সূর্যের আলোতে কাটানো উচিত, কারণ ভিটামিন ডি সূর্যালোক থেকে শরীরে উৎপাদিত হয়।”
অন্যদিকে, চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ সুমন বলেন, “ভিটামিন ডি কমে গেলে ত্বকে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী ঘাটতি শারীরিক দুর্বলতা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।”
অর্থাৎ, স্বাস্থ্য সচেতন প্রতিটি মানুষের উচিত নিয়মিত ভিটামিন ডির মাত্রা পরীক্ষা করানো এবং প্রয়োজনে সঠিক পরামর্শ নিয়ে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা।
প্রতিদিন সকাল বা বিকেলে সূর্যের আলোতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় কাটানো।
ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাছ, ডিমের কুসুম, দুধ এবং বিভিন্ন দুগ্ধজাত দ্রব্য খাওয়া।
প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ।
নিয়মিত শরীরচর্চা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন।
ভিটামিন ডি শুধু হাড়ের জন্য নয়, শরীরের সামগ্রিক সুস্থতা রক্ষার জন্যও অপরিহার্য। এর ঘাটতি শুধু পা, কোমর বা পিঠে ব্যথার কারণ নয়, বরং টাইপ ২ ডায়াবেটিস, অবসাদ, ক্লান্তি এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়ায়। তাই নিয়মিত ভিটামিন ডির মাত্রা খেয়াল রাখা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত স্বাস্থ্যবতী জীবনযাপনের জন্য।
সংক্ষিপ্ত তথ্য:
ভিটামিন ডি হাড় মজবুত করে, ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে।
ভিটামিন ডি কমে গেলে পা ও কোমর ব্যথা, টাইপ ২ ডায়াবেটিস, অবসাদ, ক্যানসারসহ নানা রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
সূর্যালোক, ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার ও সাপ্লিমেন্টের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ করা যায়।
ভিটামিন ডির অভাব এড়াতে সচেতন হওয়া আজকের দিনে অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ