
ছবি: সংগৃহীত
দেশের নরসিংদীর পলাশে অবস্থিত দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন গত দীর্ঘ সময় ধরে জ্বালানি সংকটে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। গ্যাস সরবরাহের ঘাটতির কারণে কেন্দ্রের সাতটি ইউনিটের মধ্যে বর্তমানে সবগুলোই বন্ধ রয়েছে, যা জাতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে।
ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী মো. এনামুল হক বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, গত দুই বছর ধরে গ্যাস সংকটের কারণে কেন্দ্রের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তিনি বলেন, “ঈদুল আজহার পর থেকে গ্যাস সংকট আরও প্রকট আকার নিয়েছে, যার ফলে আমাদের ৩৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৪ নম্বর ইউনিট, ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৫ নম্বর ইউনিট এবং ৩৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৭ নম্বর ইউনিটের উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।”
প্রকৌশলী মো. এনামুল হক আরও জানান, সরকার সার কারখানার গ্যাস সরবরাহ প্রাধান্য দেওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। তারা ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বিকল্প গ্যাস সরবরাহের জন্য আবেদন জানিয়েছে। গ্যাস সরবরাহ পেলে কেন্দ্র আবার পূর্ণক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে সক্ষম হবে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, “এই তিনটি ইউনিট সম্পূর্ণ চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন রয়েছে। শুধু গ্যাস সরবরাহ ফেরানো হলে দ্রুত এগুলো উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।”
তবে গ্যাস সংকটের পাশাপাশি যান্ত্রিক সমস্যাও বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করছে। ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৩ নম্বর ইউনিট, যার ক্ষমতা ৩৬০ মেগাওয়াট, দীর্ঘদিন ধরে টারবাইনের রোটরের ত্রুটির কারণে বন্ধ রয়েছে। তবে বর্তমানে সেটির মেরামতের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। গ্যাস সরবরাহ পুনরায় শুরু হলে এটি দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা হবে বলে জানানো হয়েছে।
একই সঙ্গে জানা যায়, ২০১০ সালের জুন মাসে ৬ নম্বর ইউনিটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণে টারবাইন পুড়ে যাওয়ায় সেটি চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। এই ইউনিটটির উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ২১০ মেগাওয়াট।
ঐতিহাসিক দিক থেকে ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৭ সালে রাশিয়ার টেকনোপ্রম এক্সপার্ট কর্তৃক নির্মিত ১ নম্বর ইউনিট দিয়ে, যা ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে চালু হয়ে মাত্র ৫৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছিল। এর দুই বছর পর ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ২ নম্বর ইউনিটটি চালু হয়, যার ক্ষমতাও ছিল ৫৫ মেগাওয়াট। কিন্তু এই দুই ইউনিটেও দীর্ঘদিন ধরে যান্ত্রিক সমস্যার কারণে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
বিদ্যুৎ বিশ্লেষকরা বলছেন, ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সমস্যায় দেশের বিদ্যুৎ সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে শিল্পখাতসহ অন্যান্য খাতের বিদ্যুৎ সরবরাহে এ ধরনের ঘাটতি দীর্ঘস্থায়ী হলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
উল্লেখযোগ্য, ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার স্থায়ী ও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছেন, দ্রুত গ্যাস সংকট মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যাতে এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দেশের বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত হতে পারে এবং নাগরিক ও শিল্পের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে সহায়ক হয়।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসলে দেশের বিদ্যুৎ সংকট দীর্ঘমেয়াদী এবং জটিল রূপ ধারন করতে পারে, যা শিল্প ও জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে বলে মত তাদের। তাই এখনই প্রয়োজন গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের অবকাঠামো উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের পদক্ষেপ।
সংক্ষিপ্ত তথ্য:
-
ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৭টি ইউনিটের মধ্যে বর্তমানে সব বন্ধ।
-
৪, ৫ ও ৭ নম্বর ইউনিট গ্যাস সংকটে বন্ধ।
-
৩ নম্বর ইউনিট মেরামতের শেষে চালু হবে।
-
৬ নম্বর ইউনিট আগুনে পুড়ে চিরতরে বন্ধ।
-
১ ও ২ নম্বর ইউনিট দীর্ঘদিন যান্ত্রিক ত্রুটিতে বন্ধ।
গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হলে ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদ ব্যক্ত করছেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ