
ছবি: সংগৃহীত
চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এসেছে বিদেশি বিনিয়োগে অভূতপূর্ব উত্থান। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৮৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১৪ দশমিক ৩১ শতাংশের বেশি। আগের প্রান্তিকের সঙ্গে তুলনা করলে ৭৬ দশমিক ৩১ শতাংশ বেড়েছে এই বিনিয়োগ। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে মোট বিদেশি তহবিল এসেছে ১৫৭ কোটি ৬১ লাখ ডলার। এর মধ্যে বিভিন্ন মুনাফা, আন্তঃকোম্পানি ঋণ পরিশোধসহ নানা উপায়ে বাইরে গেছে ৭১ কোটি ১৫ লাখ ডলার। এর ফলে নিট বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ৮৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। তুলনামূলকভাবে, গত বছরের জানুয়ারি-জুন মাসে নিট বিনিয়োগ ছিল মাত্র ৪০ কোটি ৩৪ লাখ ডলার এবং গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে এটি ছিল ৪৯ কোটি ডলার।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের গতিশীল নীতিমালা, বিশেষ করে জমিসহ নানা সেবা সহজ করার কারণে এই উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ প্রবাহ বেড়েছে। তবে তারা সতর্ক করেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অবসান হলে বিনিয়োগ প্রবাহ আরও দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারত।
বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে মার্চ শেষে দাঁড়িয়েছে ১০৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১২ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরের শেষে ছিল ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ডলার এবং গত বছরের জুনে ছিল ১০ হাজার ৩৪১ কোটি ডলার। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে দেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ।
বিশ্লেষকরা জানান, পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে অধিকাংশ ঋণ ছিল উচ্চ সুদের বাণিজ্যিক ঋণ। বর্তমান সরকার বাণিজ্যিক ঋণ কমিয়ে তুলনামূলক কম সুদের ঋণ গ্রহণ করছে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ মার্চ শেষে ছিল ৮ হাজার ৪৮৯ কোটি ডলার, যা গত ডিসেম্বরের ৮ হাজার ৪৩১ কোটি ডলারের তুলনায় কিছুটা বেশি। বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ ছিল ১ হাজার ৯৮৭ কোটি ডলার, যা ডিসেম্বরের ১ হাজার ৯৪২ কোটি ডলারের থেকে সামান্য বেড়েছে।
২০২৪ সালের জুনের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) থেকে ১৩৪ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছে। এরপর বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, এআইআইবিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা থেকে আরও ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ এসেছে, যা অধিকাংশই কম সুদের।
এদিকে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা গেছে। এসব অর্থনৈতিক প্রভাবের কারণে ২০২৪ সালের জুন শেষে দেশের মোট গ্রস রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে। তবে আইএমএফের ব্যবহৃত বিপিএম৬ হিসাব পদ্ধতির আওতায় রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারে, যা গত ২৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বর্তমানে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) ২০২ কোটি ডলার পরিশোধের পর গ্রস রিজার্ভ কিছুটা কমে ২৯ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বিপিএম৬ অনুযায়ী বর্তমান রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। উল্লেখযোগ্য যে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময় রিজার্ভ মাত্র ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারে ছিল। আর ২০২১ সালের আগস্টে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের উপরে।
অর্থনীতিবিদরা মন্তব্য করেন, দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিদেশি বিনিয়োগের এই ধারা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে দেশের শিল্প, অবকাঠামো ও অন্যান্য খাতে দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব হবে। এছাড়া কম সুদের ঋণ গ্রহণ করায় দেশের ঋণভার manageable হবে বলে তারা আশাবাদী।
তবে তারা সতর্ক করেন যে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সরকারি নীতিমালায় ধারাবাহিকতা না থাকলে বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ কমে যেতে পারে। তাই সরকারের উচিত বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ বজায় রেখে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা।
বিশ্লেষকরা আরও বলেন, দেশের রিজার্ভ বাড়াতে রেমিট্যান্স প্রবাহ অব্যাহত রাখতে হবে এবং ঋণ ব্যবস্থাপনায় সতর্ক থাকতে হবে যাতে অর্থনৈতিক ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে থাকে।
সামগ্রিকভাবে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের অভূতপূর্ব বৃদ্ধি এবং ঋণের সুসংগঠিত ব্যবহার দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক সংকেত। আগামীতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এই প্রবণতা ধরে রাখার জন্য কাজ করতে হবে যাতে দেশের অর্থনৈতিক লক্ষ্য সফল হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ