
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশ যে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে, তা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত দেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প, নিটওয়্যার, টেক্সটাইলসহ সমগ্র শিল্পখাতকে বড় ধরনের সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও বাণিজ্য বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ তিনটি বড় ভুলের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি। প্রথমত, আলোচনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অন্তর্ভুক্ত না করা; দ্বিতীয়ত, বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ রপ্তানিকারকদের অন্ধকারে রাখা; এবং তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের বাদ দেওয়া।
ফলে ২৮ দফা বৈঠক ও বহু অনলাইন মিটিংয়ের পরও যুক্তরাষ্ট্র কেবল মাত্র ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। অর্থাৎ আগে থেকে থাকা ১৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে নতুন ৩৫ শতাংশ যোগ হয়ে মোট শুল্ক হবে ৫০ শতাংশ। এ হার দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিযোগী দেশ ভারত (২৮%) ও পাকিস্তান (২৯%) এমনকি ভিয়েতনাম (২০%) এর চেয়ে অনেক বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের আলোচনা পদ্ধতি ছিল গোপনীয় ও অগোছালো। এতে ব্যবসায়ী এবং রপ্তানিকারকরা উপেক্ষিত বোধ করেছেন। বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, “যারা শতভাগ রপ্তানি করছে তারা জানেই না সরকার কী করছে। আমরা ছিলাম পুরোপুরি উপেক্ষিত। এতে করে বাস্তবচিত্র তুলে ধরার সুযোগই পাওয়া যায়নি।”
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, “এ ধরনের উচ্চ শুল্কের মধ্যে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। এর প্রভাব শুধু পোশাক খাতে সীমাবদ্ধ থাকবে না, ব্যাংকিং, বন্দর, পরিবহন, প্যাকেজিংসহ পুরো রপ্তানি ইকোসিস্টেমেই ধাক্কা লাগবে।”
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে যেভাবে আলোচনা পরিচালনা করা হয়েছে, তাতে কোনো সুপরিকল্পিত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। তথ্যের স্বচ্ছতা ছিল না। যারা দীর্ঘদিন এ বিষয়ে কাজ করছেন, তাদের বাদ দিয়ে যারা কখনো আলোচনায় যাননি, তাদের নিয়েই নেগোসিয়েশন টিম করা হয়েছে।”
বিশ্লেষকরা যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তকে পক্ষপাতদুষ্ট বলেও আখ্যা দিয়েছেন। তাদের মতে, ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি ১২৫ বিলিয়ন ডলার, ভারতের ৪৫ বিলিয়ন ডলার, অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ পাল্টা শুল্ক আরোপে বাংলাদেশের ওপরই সবচেয়ে বেশি চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করার যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। ভারত-পাকিস্তান কত শুল্কে পড়বে তা এখনো পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশ যদি একা উচ্চ শুল্কে পড়ে, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে বড় বিপর্যয় নেমে আসবে।”
তিনি আরও বলেন, “শুধু অর্থনৈতিক প্রভাব নয়, এর সামাজিক প্রভাবও রয়েছে। যখন উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, তখন ক্রেতারা বিকল্প খুঁজবে। ফলে রপ্তানি কমবে, কর্মসংস্থান কমবে এবং দারিদ্র্য বাড়বে।”
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, নতুন শুল্কহার কার্যকরের সময় ১ আগস্ট এবং এই সময় আর পেছানো হবে না। ট্রুথ সোশ্যাল-এ দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, “১ আগস্ট থেকেই সব অর্থ পরিশোধযোগ্য হয়ে যাবে। কোনো ছাড় বা সময় বাড়ানো হবে না।”
এছাড়া ট্রাম্প যে চিঠি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠিয়েছেন, তাতে দুটি কঠিন শর্ত রাখা হয়েছে—
১. যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে বা শুল্ক বাড়াবে, বাংলাদেশকেও তা অনুসরণ করতে হবে।
২. যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়া শুল্ক সুবিধা কোনো তৃতীয় দেশকে দেওয়া যাবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই শর্তগুলো বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ‘ফেভার ওয়ান, ফেভার অল’ নীতির আওতায় কোনো দেশকে আলাদা সুবিধা না দিয়ে সব সদস্য দেশকে সমান সুবিধা দিতে হয়।
বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে ওয়াশিংটনে ইউএসটিআরের সঙ্গে আলোচনা চলছে। ৯, ১০, ১১ ও ১২ জুলাই টানা বৈঠক নির্ধারিত হয়েছে। এতে অংশ নিচ্ছেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানও।
তবে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, “টিমে যদি সঠিক মানুষ না থাকে, যদি প্রস্তুতি দুর্বল থাকে, তাহলে ফলাফল ভালো আসার সম্ভাবনা নেই। আমাদের অবশ্যই মার্কিন পক্ষের রিপোর্ট ধরে ধরে সংস্কারের প্রস্তাব দিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “শুল্ক আরোপের বিষয় কাগজে লেখা হয়েছে, পাথরে নয়। ট্রাম্প যদি পরিবর্তন চান, তা সম্ভব। তাই লবিস্ট নিয়োগ, কার্যকর দূতাবাস, ও দ্রুত শিপমেন্টের মতো পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে।”
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “৫০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে মার্কিন বাজারে টিকে থাকা যাবে না। বড় কারখানাগুলো কিছু ছাড় দিয়ে টিকে গেলেও, ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো ধুঁকতে থাকবে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে, শ্রমিক চাকরি হারাবে।”
তিনি আরও বলেন, “ভিয়েতনাম এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি করতে যাচ্ছে। তারা বড় ছাড় পাবে। তখন মার্কিন বাজার তাদের দখলে যাবে।”
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, “আলোচনায় ব্যবসায়ীদের রাখা হয়নি। সরকার আমলানির্ভর আলোচনা করেছে। আমরা মার্কিন তুলা আমদানি করি, অথচ সেই তুলার ওপর বাজেটে অগ্রিম আয়কর বসানো হয়েছে। এতে করে ট্রাম্প প্রশাসন খুশি হওয়ার সুযোগ কোথায়?”
২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এখন ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে বাংলাদেশকে প্রতি বছর শুল্ক দিতে হবে প্রায় ৪২০ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগে ছিল ১২৬ কোটি ডলার।
ট্রাম্প প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তের ফলে দেশটির শুল্ক আয় বাড়বে। দেশটির অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট জানান, চলতি বছর এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ১২২ বিলিয়ন ডলার শুল্ক আয় করেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এটি ৩০০ বিলিয়নে পৌঁছাতে পারে।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, “রপ্তানির পণ্য ও বাজার বৈচিত্র্য এখন সময়ের দাবি। শুধু ইউরোপ-আমেরিকা নয়, এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় প্রবেশ করতে হবে। এফটিএ আলোচনা দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে।”
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদেরও উদ্যোগ নিতে হবে। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, দ্রুত শিপমেন্ট, নতুন বাজার সন্ধান এবং কার্যকর দূতাবাস—সব মিলিয়ে সম্মিলিত প্রয়াসে এগোতে হবে।”
সার্বিকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান শুল্কসংক্রান্ত জটিলতা বাংলাদেশকে অনেকটাই কোণঠাসা করে ফেলেছে। এখন কূটনৈতিক দক্ষতা, পেশাদার নেগোসিয়েশন এবং দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপের ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের রপ্তানিখাত ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ। সময় কম, দায়িত্ব অনেক, তবু এখনো আলোচনার সুযোগ আছে—প্রশ্ন হলো, আমরা কতটা প্রস্তুত?
বাংলাবার্তা/এমএইচ