
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার হৃদয়ে, বাহাদুর শাহ পার্কের পাশে অবস্থিত প্রাচীন পানির ট্যাংকটি আমাদের শহরের ইতিহাসের এক নীরব কিন্তু শক্তিশালী সাক্ষী। এক সময় এটি ছিল আধুনিকতার প্রতীক, হাজারো মানুষের জীবনের অনিবার্য অংশ; আজ তা পরিণত হয়েছে অবহেলা, ভুল বোঝাবুঝি এবং স্থানীয় দখলদারিত্বের জেরের শিকার এক পরিত্যক্ত স্থাপনায়। এই ট্যাংকটি কেবল একটি নির্মিত কাঠামো নয়, এটি ঢাকার নগর উন্নয়নের ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়, যা আজ হুমকির মুখে পড়েছে। বর্তমান সময়ে এর অবস্থা দেখে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি আমাদের ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলতে বসেছি?
ঢাকার প্রথম আধুনিক পানি সরবরাহ প্রকল্পের সূচনা
১৮৭৪ সালে চাঁদনীঘাটে শুরু হয় ঢাকার প্রথম ওয়াটার ওয়ার্কস প্রকল্প, যা ছিল শহরের বিশুদ্ধ পানি সংকট দূর করার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তখনকার কূপ, পুকুর, ও নদীর পানি ছিল জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক ও কেন্দ্রীয় পানির ব্যবস্থা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। এই প্রেক্ষাপটে, ১৮৭৮ সালের ২৪ মে বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তরে নির্মিত হয় ঢাকার প্রথম ওভারহেড পানির ট্যাংক, যা ছিল বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক পানি সরবরাহের নিদর্শন।
নবাব পরিবারের অবদান ও পানি সরবরাহের নৈতিক দিক
এই প্রকল্পে নবাব খাজা আবদুল গনি এক লাখ টাকা এবং তাঁর পুত্র নবাব আহসানউল্লাহ পঞ্চাশি হাজার টাকা অনুদান দেন। সঙ্গে পৌরসভা যোগ করেছিল আরও ৯০ হাজার টাকা। একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল, এই পানি সবার জন্য সহজলভ্য ও বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হবে। এই শর্ত ছিল সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা আধুনিক বাংলাদেশের নাগরিক সেবার মূলে ছিল।
স্থাপত্যশৈলী ও কার্যকারিতা: আধুনিকতার ছোঁয়া
ট্যাংকটির স্থাপত্য ছিল ইউরোপীয় ও স্থানীয় শিল্পকলার এক অনবদ্য সংমিশ্রণ। লাল ইটের নির্মিত গম্বুজাকৃতির এই বিশাল ট্যাংক ছিল পাঁচতলা সমান উচ্চতা সম্পন্ন। নিচে অবস্থিত পাম্প হাউসে পানি উত্তোলিত হতো, যা উপরের রিজার্ভারে সংরক্ষণ করে পাইপলাইনের মাধ্যমে আশপাশের এলাকায় বিতরণ করা হতো। এর ফলে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া সহজ হয়ে ওঠে এবং কলেরা, টাইফয়েডের মতো প্রাণঘাতী পানিবাহিত রোগের প্রকোপ কমে যায়।
অবহেলা, দখলদারিত্ব ও স্থাপনার বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে এই ঐতিহাসিক ট্যাংকটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তার চারপাশে গড়ে উঠেছে দোকান, ইট-বালুর গুদাম, এমনকি একটি অস্থায়ী মাজার। ট্যাংকের নিচের অংশ দখল করে মাজার নির্মাণ করা হয়েছে, আর এর প্রাচীর ভেঙে মাজারের প্রবেশ পথ তৈরি হয়েছে। স্থানীয়রা এটিকে ‘ট্যাংকির গলি’ নামে চেনে। ২০২০ সালে রাজউক এটিকে ‘ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ’ হিসেবে ঘোষণা করলেও বাস্তবে সংরক্ষণে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রশাসনিক উদাসীনতা, সচেতনতার অভাব এবং বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দখল এই নিদর্শনটির ভবিষ্যতকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে।
ঐতিহ্য সংরক্ষণে রাজনৈতিক ও সামাজিক বাধা
বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশে ঐতিহ্য সংরক্ষণ এখনও ‘ডেস্ক পলিসি’ পর্যায়েই আটকে আছে। আইনে সংরক্ষণের কথা থাকলেও মাঠে কার্যকর নজরদারি নেই। স্থানীয় জনগণ, বিশেষ করে যারা এর আশেপাশে বসবাস ও ব্যবসা করেন, তাদের অংশগ্রহণ ব্যতীত ঐতিহাসিক স্থানগুলো টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। তথ্যের অভাব ও পর্যটন, শিক্ষা ক্ষেত্রে এর ব্যবহার না হওয়ায় এটি এক বিস্মৃত অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত ও করণীয়
স্থানীয় ইতিহাসবিদ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম মনে করেন, “এই ধরনের স্থাপনা শুধুমাত্র পুরনো বস্তু নয়, এগুলো আমাদের অতীতের পরিচয় বহন করে। এগুলো সংরক্ষণ না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিজেদের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।” আরেকটি গবেষক বলেন, “সঠিক পরিকল্পনা ও সচেতনতার মাধ্যমে এই ট্যাংককে মিনি মিউজিয়াম বা হেরিটেজ জোনে রূপান্তর করা যেতে পারে, যা পর্যটন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”
জনসচেতনতা বৃদ্ধির পথ
স্কুল-কলেজ পর্যায় থেকে এই স্থাপনার গুরুত্ব নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা দরকার। গণমাধ্যমে তথ্যচিত্র, প্রতিবেদন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা সম্ভব। স্থানীয় প্রশাসন, রাজউক ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে একত্রে কাজ করে ট্যাংক সংরক্ষণের প্রকৃত উদ্যোগ নিতে হবে। স্থানীয় জনগণ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমন্বয় করে দখলদারিত্ব বন্ধ এবং ট্যাংকটির পরিবেশ পুনর্গঠন করা সম্ভব।
ইতিহাসের সংরক্ষণেই শক্তিশালী ভবিষ্যত
বাহাদুর শাহ পার্কের এই পানির ট্যাংক শুধু ঢাকার নয়, সমগ্র বাংলাদেশের নাগরিক স্থাপত্য ও নগর উন্নয়নের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। আমাদের উচিত একত্রে উদ্যোগ নিয়ে এটিকে নতুন প্রাণ দিতে পারা। যাদের হাতে আজ আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব, তাদের করণীয় অনেক বড় এবং তা সময়সাপেক্ষ। “যে জাতি তার ইতিহাস সংরক্ষণ করতে জানে না, সে জাতি ভবিষ্যৎ গড়তেও পারে না।” তাই এখনই জেগে উঠার, সচেতন হওয়ার এবং ঐতিহাসিক এই স্মৃতিস্তম্ভটিকে শুধুমাত্র ইতিহাসের স্মারক হিসেবেই নয়, গৌরবময় ভবিষ্যতের সিঁড়ি হিসেবেও গড়ে তোলার সময়।
ঢাকার প্রথম আধুনিক পানির ট্যাংকটির এই অবস্থা আমাদের ইতিহাসের প্রতি অবহেলার করুণ প্রতিফলন। এটি যেন আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের জন্য সতর্কবার্তা—আগামী প্রজন্মের জন্য আমাদের কি ইতিহাস রেখে যাচ্ছি? এখনই সময় সচেতন হওয়ার এবং ঐতিহ্য রক্ষায় সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের।
বাংলাবার্তা/এমএইচ