
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে গত কিছু মাস ধরে মব ভায়োলেন্স বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলার ঘটনাগুলো বৃদ্ধি পেয়ে জনজীবন এবং সামাজিক শান্তিতে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ছয় মাসে অন্তত ১৪১টি মবের ঘটনায় ৮৩ জন নিহত হওয়ার মতো মর্মান্তিক পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে, কেন এই ‘মব’ থামানো যাচ্ছে না এবং এর পেছনে কি রয়েছে?
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ব্যাপক পরিমাণে ঘটেছে, যা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আতঙ্ক ও অস্থিরতা তৈরি করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব মব সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি করেছে। তবে রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত ও ন্যারেটিভের কারণে এর সঠিক প্রতিকার এখনো কঠিন।
কিছু রাজনৈতিক দল মবকে ‘জনরোষ’ হিসেবে দেখায়, আবার কেউ কেউ এটিকে ক্ষুব্ধ মানুষের ‘প্রেসার’ বলেও অভিহিত করেছেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব এমন ধারণা প্রকাশ করেছেন যে, মবগুলো মূলত পতিত আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে নির্যাতিত মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। অন্যদিকে কিছু রাজনৈতিক মহল মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় এই দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মব ভায়োলেন্সের ঘটনায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অভিযুক্ত হলেও প্রত্যেকেই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। এনসিপির বিরুদ্ধে মব ঘটানোর অভিযোগ বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে, যার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের পটিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অপসারণ করতে হয়।
এক মানবাধিকার কর্মী জানান, মব ঘটানোর পেছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, গোষ্ঠীগত বিরোধ এবং ব্যক্তিগত বিবাদ রয়েছে। বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক কিছু গোষ্ঠী ‘তৌহিদী জনতা’ নামের ছত্রছায়ায় মব সৃষ্টি করেছে। যদিও এসব গোষ্ঠীর রাজনৈতিক অবস্থান সীমিত হলেও তাদের কর্মকাণ্ড দেশের শান্তির জন্য হুমকি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তাদের দল কখনো মবের পক্ষে নেই এবং কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে অনেক দুর্বলতা থেকে যায়, যার ফলে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও প্রতিহিংসার কারণে দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে মব ভায়োলেন্সের চারটি ঘটনায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। কুমিল্লার মুরাদনগরের এক গ্রামে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি জানায়, গত ছয় মাসে ১৪১টি মবের ঘটনায় ৮৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে মব ভায়োলেন্স রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী দাবি করেছেন, মবভুক্তদের গ্রেফতার ও আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করেন, গত বছরের অগাস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর থেকে মবের ঘটনাগুলো বেড়েছে এবং সরকারের পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়।
বিশ্লেষকরা এটাও বলছেন, সরকার কখনো কখনো মব ভায়োলেন্সের পেছনে ‘প্রচ্ছন্ন সমর্থন’ রেখেছে বলে ধারণা গড়ে উঠেছে, বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে হামলার সময় সরকার নিরব ছিল।
কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মন্তব্য করেছেন, “সরকার না চাইলে মব ঘটতে পারে না”। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, মব ভায়োলেন্সের পেছনে যে উদ্দেশ্য থাকতে পারে, তা হলো দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে নির্বাচন প্রলম্বিত করার পরিকল্পনা।
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “মবের বেশিরভাগ ঘটনা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার কারণে ঘটছে। যখন রাজনৈতিক দল বা শক্তি এসবের পক্ষে যুক্তি দেয়, তখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়।”
বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জামায়াতের সিনিয়র নেতা মো. তাহের মব ভায়োলেন্স বন্ধে সরকারের গুরুত্বারোপ করেন। তারা মনে করেন, অতীতে অপরাধীদের যথাযথ বিচার না হওয়ায় ক্ষুব্ধ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি একক কোনো গোষ্ঠীর কাজ নয়; এটা সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা কারণে সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও বিদ্বেষ এই পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, মব ভায়োলেন্স নিয়ন্ত্রণ না হলে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। তারা সরকার, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, শুধুমাত্র কঠোর আইন প্রয়োগই নয়, বরং মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব।
মব ভায়োলেন্স দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক দল, সরকার ও সমাজের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। কারণ, মবের আগুন যে একবার ছড়িয়ে পড়লে তা দমন করা কঠিন এবং তার প্রভাব দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের উপরেও পড়বে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা, মানবাধিকার সংগঠন, বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার।
বাংলাবার্তা/এসজে