
ছবি: সংগৃহীত
রাখাইন রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ান। চলমান সংকট নিরসনে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক যে প্রচেষ্টা চলছে, সেটিকে কার্যকর ও উৎসাহব্যঞ্জক হিসেবে অভিহিত করেছে জোটটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।
শুক্রবার (১১ জুলাই) শেষ হওয়া ৫৮তম আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সভার (এএমএম) শেষ দিনে গৃহীত এক যৌথ ঘোষণাপত্রে এই বার্তা দেওয়া হয়। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত চার দিনব্যাপী এই সম্মেলনে আসিয়ান সদস্য দেশগুলোর পাশাপাশি তাদের বৈশ্বিক অংশীদার দেশগুলোর মোট ১,৫০০ জনেরও বেশি প্রতিনিধি অংশ নেন। এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘অন্তর্ভুক্তি ও টেকসইতা’, যেখানে শরণার্থী সংকট, মানবিক সহায়তা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয় গুরুত্ব পায়।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা এবং ২০১৭ সালের সেনা অভিযান থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা এখনো কক্সবাজার ও ভাসানচরে মানবেতর অবস্থায় রয়েছে। এই বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ থাকলেও দীর্ঘদিন ধরেই প্রক্রিয়াটি স্থবির হয়ে ছিল। সম্প্রতি আবারও কিছু অগ্রগতি দেখা দেওয়ায় তা স্বাগত জানিয়েছে আসিয়ান।
বারনামা সংবাদ সংস্থার খবরে বলা হয়েছে, যৌথ বিবৃতিতে আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মিয়ানমারের প্রতি শান্তি, স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা রাখাইন রাজ্যে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও পুনর্মিলন জোরদার করার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীসহ বাস্তুচ্যুতদের নিরাপদ, স্বেচ্ছায় এবং মর্যাদাসম্পন্ন প্রত্যাবাসন আমাদের অগ্রাধিকার।”
আসিয়ান জানিয়েছে, তারা মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে চলমান দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগ, বিশেষ করে যাচাইকৃত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। পাশাপাশি এই প্রত্যাবাসনকে বাস্তবায়নযোগ্য করে তুলতে প্রাথমিক প্রয়োজন মূল্যায়ন (Preliminary Needs Assessment–PNA) অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে জোটটি।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “আমরা প্রত্যাশা করি যে, আসিয়ান মহাসচিব এবং সংশ্লিষ্ট মানবিক সংস্থাগুলো এই প্রক্রিয়ায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। সেই সঙ্গে একটি সমন্বিত প্রয়োজন মূল্যায়ন (Comprehensive Needs Assessment–CNA) পরিচালনার জন্য উপযোগী পরিবেশ দ্রুতই নিশ্চিত করা হবে।”
বিশ্লেষকদের মতে, আসিয়ানের এই বক্তব্য একটি কূটনৈতিক চাপের ইঙ্গিত দেয়, যার লক্ষ্য হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেইসঙ্গে, আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিভঙ্গিতেও বাংলাদেশ যে দীর্ঘদিন ধরে মানবিকতা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে, সেটিকে স্বীকৃতি দেওয়ার বার্তাও এতে নিহিত।
এই সম্মেলনের মাধ্যমে আসিয়ান সদস্য দেশগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে এক ধরনের আঞ্চলিক ঐক্যমতের ইঙ্গিত দিয়েছে বলেও অভিজ্ঞ কূটনীতিকরা মনে করছেন। তবে বাস্তবে প্রত্যাবাসন কার্যকর হতে গেলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়ন ছাড়া তা সম্ভব নয় বলেও তারা সতর্ক করেছেন।
বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে ১ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার একটি পাইলট গ্রুপের প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকা প্রস্তুত করেছে এবং এই প্রক্রিয়ায় চীন ও আসিয়ানের মধ্যস্থতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এখন দেখার বিষয়—এই স্বাগত ও কূটনৈতিক সমর্থনের বাস্তব প্রতিফলন কতটা দ্রুত এবং কার্যকরভাবে মাঠে দেখা যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ