
ছবি: সংগৃহীত
টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বধাপ হচ্ছে প্রি-ডায়াবেটিস। এটি এমন এক শারীরিক অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তির রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হলেও তা এখনো টাইপ-২ ডায়াবেটিস হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তবে এটি একটি সতর্কসংকেত—যার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়, এখনই জীবনযাত্রায় পরিবর্তন না আনলে ভবিষ্যতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে রূপ নিতে পারে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ‘ডায়াবেটিস ইউকে’র সিনিয়র ক্লিনিক্যাল অ্যাডভাইজার এস্থার ওয়ালডেন এবং ইউনিভার্সিটি অফ নটিংহ্যামের নিউট্রিশন ও ডায়েটেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. অ্যামান্ডা অ্যাভেরি এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
তাদের মতে, প্রি-ডায়াবেটিস মানেই ডায়াবেটিস নিশ্চিত—এই ধারণা একেবারেই ভুল। জীবনধারায় সঠিক পরিবর্তন আনা গেলে শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে রূপ নেওয়া পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রেই এই পর্যায় থেকে সম্পূর্ণ মুক্তিও মিলতে পারে।
প্রি-ডায়াবেটিস বোঝার উপায়
প্রায় ক্ষেত্রেই প্রি-ডায়াবেটিসের নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ থাকে না। তাই অধিকাংশ মানুষ এটি সম্পর্কে জানতে পারেন না, যতক্ষণ না রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষায় রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি ধরা পড়ে। সাধারণত বয়স, ওজন, নৃতাত্ত্বিক পরিচয় (ethnicity), খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা—এই সবকিছুই প্রি-ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
কেন হয় প্রি-ডায়াবেটিস?
ডা. অ্যামান্ডা অ্যাভেরির মতে, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য শরীর ইনসুলিন নামের হরমোন উৎপাদন করে। কিন্তু যদি শরীর অতিরিক্ত মেদে ভরে যায়, বিশেষত পেটের চারপাশে চর্বি জমে, তখন ইনসুলিন ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীলতা হারাতে থাকে এবং তখন রক্তে গ্লুকোজ বাড়তে থাকে। তখনই দেখা দেয় প্রি-ডায়াবেটিস।
কীভাবে প্রতিরোধ করবেন?
বিশেষজ্ঞদের মতে, চারটি মূল বিষয়ের ওপর নজর দিলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব—
১. ওজন কমানো ও পার্সোনাল ফ্যাট থ্রেশহোল্ড
‘লাইফ উইদাউট ডায়াবেটিস’ বইয়ের লেখক ডা. রয় টেইলর তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, একজন ব্যক্তির ওজনের মাত্র ১০% কমলেই লিভার ও অগ্ন্যাশয়ের চর্বি কমে এবং গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। তার মতে, স্থূলতার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ব্যক্তির পার্সোনাল ফ্যাট থ্রেশহোল্ড—অর্থাৎ দেহে চর্বি জমা রাখার সহনশীল সীমা। এই সীমা পার হলেই ডায়াবেটিসের লক্ষণ দেখা দেয়।
দ্রুত ওজন কমানো কি নিরাপদ?
যদিও সাধারণভাবে ধীরে ওজন কমানোর পরামর্শই দেওয়া হয়, তবে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধের ক্ষেত্রে দ্রুত ওজন কমানো কার্যকর হতে পারে, যদি সেটা নিরীক্ষণের মধ্যে থাকে এবং পুষ্টি ঠিকঠাক মেলে।
২. ওজন ধরে রাখা
ওজন কমানোর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই ওজন ধরে রাখা। অতিমাত্রায় ক্যালরি কমিয়ে খেলে ওজন দ্রুত কমানো সম্ভব হলেও তা দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হয় না। তাই ভিগান ডায়েট, নিরামিষ আহার বা লো-কার্ব (low-carb) খাবারের মতো স্বাস্থ্যকর ও সহজে অনুসরণযোগ্য খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলাই উত্তম।
৩. যেসব খাবার এড়িয়ে চলবেন
গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু নির্দিষ্ট খাবার টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। এর মধ্যে রয়েছে—
সুগারযুক্ত পানীয়: এগুলো রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়ায়, অথচ পেট ভরায় না।
রেড মিট ও প্রক্রিয়াজাত মাংস: অতিরিক্ত খেলে ঝুঁকি বাড়ে।
পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট: যেমন ময়দা, হোয়াইট ব্রেড, মিষ্টিজাতীয় স্ন্যাক্স ইত্যাদি।
আলু ও বিশেষ করে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই: উচ্চ গ্লাইসেমিক সূচকের কারণে ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
৪. যেসব খাবার খাওয়া উচিত
কিছু খাবার টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সহায়ক বলে প্রমাণিত হয়েছে। যেমন—
ফল ও শাকসবজি: বিশেষত মূলযুক্ত সবজি ও ব্লুবেরি, আঙুর, আপেল জাতীয় ফল।
গোটা শস্যজাতীয় খাবার: দিনে অন্তত ৪৫ গ্রাম গোটা শস্য খেলে ঝুঁকি কমে।
কম চর্বিযুক্ত দই ও পনির: নিয়মিত খেলে ঝুঁকি ৫–১৪% পর্যন্ত কমে।
চা ও কফি (চিনি ছাড়া): নিয়মিত খেলে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ে।
আতঙ্ক নয়, এটি একটি সুযোগ
ডা. অ্যামান্ডা অ্যাভেরির মতে, প্রি-ডায়াবেটিস হলো একটি স্বাস্থ্য সংকেত। এটি ভয় পাওয়ার বিষয় নয়, বরং একটি সুযোগ, যাতে আপনি সময় থাকতে সচেতন হতে পারেন।
তিনি পরামর্শ দেন, পুরো ডায়েট রাতারাতি বদলাতে না পারলেও ছোট ছোট পরিবর্তন আনুন। যেমন প্রতিদিনের একবেলার খাবারে পরিশোধিত শস্য বাদ দিয়ে গোটা শস্য ব্যবহার করা, সফট ড্রিংকের বদলে পানির অভ্যাস করা, কিংবা প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার চেষ্টা করা।
প্রি-ডায়াবেটিস মানেই টাইপ-২ ডায়াবেটিসে রূপান্তর হবে—এমনটা নয়। সচেতনতা, খাদ্যাভ্যাসে নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে এই বিপদ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা সম্ভব।
এই রোগ প্রতিরোধযোগ্য—এটাই সবচেয়ে বড় বার্তা। এটি বুঝতে পারাই হলো সুস্থ জীবনের শুরু।
বাংলাবার্তা/এমএইচ