
ছবি: সংগৃহীত
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত বেনাপোল বন্দর দীর্ঘদিন ধরেই দু’দেশের মধ্যে সবচেয়ে ব্যস্ত ও জনপ্রিয় স্থলবন্দর হিসেবে পরিচিত ছিল। চিকিৎসা, ব্যবসা, পর্যটন ও শিক্ষাসহ নানামুখী প্রয়োজনে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন এই রুট ব্যবহার করে ভারতে যাতায়াত করতেন। তবে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সেই চিত্রে এসেছে নজিরবিহীন ভাঙন। যাত্রী সংখ্যা কমেছে আশঙ্কাজনক হারে, প্রায় ১০ লাখ ৬০ হাজার। এই পতনের পেছনে রয়েছে একাধিক জটিল কারণ—ভিসা জট, অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস ব্যবস্থা, দালালচক্রের তৎপরতা, নিরাপত্তার ঘাটতি ও সরকারি নজরদারির অভাব।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর ব্যবহার করে মোট ১১ লাখ ৯০ হাজার ৮২১ জন যাত্রী যাতায়াত করেছেন। এর মধ্যে ভারতে গেছেন ৬ লাখ ৬ হাজার ৪১০ জন এবং ভারত থেকে ফিরেছেন ৫ লাখ ৮৪ হাজার ৪১১ জন। বিপরীতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যাত্রী যাতায়াতের সংখ্যা ছিল ২২ লাখ ৫ হাজার ৪৭৮ জন। অর্থাৎ যাত্রী কমেছে ১০ লাখ ৫৯ হাজার ৬৫৭ জন, যা প্রায় ৪৮ শতাংশ হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়।
এই যাত্রী প্রবাহের পতনের প্রভাব পড়েছে রাজস্বেও। আগের অর্থবছরে ভ্রমণ খাতে রাজস্ব আয় হয়েছিল প্রায় ২০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে তা নেমে এসেছে মাত্র ১১০ কোটিতে। মাত্র এক বছরে সরকার হারিয়েছে প্রায় ৯০ কোটি টাকার রাজস্ব, যা দেশের বাণিজ্যিক সীমান্ত পরিচালনায় বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০২৫ সালের ৫ আগস্টে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা প্রক্রিয়া কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি পর্যায়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও, ভারতীয় হাইকমিশন ও এর আওতাধীন ভিসা সেন্টারগুলোতে সাধারণ বাংলাদেশিদের জন্য পর্যটন, চিকিৎসা ও ব্যবসা ভিসা পাওয়া এখন রীতিমতো দুঃস্বপ্ন।
বেনাপোল আমদানি-রফতানি সমিতির সহ-সভাপতি আমিনুল হক বলেন, ‘ভারতীয়রা এখনো স্বাভাবিক নিয়মে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ভিসা পাচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশিদের জন্য ভারতীয় ভিসা কার্যত বন্ধ। ব্যবসা, চিকিৎসা ও উচ্চশিক্ষার কাজে যারা ভারতে যান, তারাই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন।’
বন্দর এলাকায় যাত্রীদের মৌলিক সেবা নিশ্চিত না হওয়ায় যাতায়াতকারীদের দুর্ভোগ বেড়েছে বহুগুণ। অভিজিৎ বিশ্বাস নামের এক যাত্রী বলেন, ‘ভ্রমণ কর বাড়ছে, কিন্তু যাত্রীসেবা বাড়ছে না। রোদ-বৃষ্টির মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ইমিগ্রেশন লাইনে। পানির ব্যবস্থা নেই, ছাউনি নেই।’
আরেক যাত্রী পলাশ বলেন, ‘ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু ব্যবহার করে মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় বেনাপোল আসা যায়। কিন্তু সকাল সাড়ে ৬টার আগে ইমিগ্রেশন খোলেই না। ফলে ভোরে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে বসে থাকতে হয়।’
এই বন্দরে যাত্রী ছাউনির অভাব, বিশুদ্ধ পানির সংকট, পর্যাপ্ত টয়লেট না থাকা, নিরাপত্তা বাহিনীর সীমিত উপস্থিতি এবং দালালদের খোলা মাঠ—সব মিলিয়ে বন্দরের ভেতরে তৈরি হয়েছে এক অনিরাপদ ও অপেশাদার পরিবেশ। নিয়মিত ছিনতাই, পাসপোর্ট নিয়ে প্রতারণা এবং জাল ভিসা বানিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা এখানে নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে উঠেছে।
বন্দরের আশপাশের হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর সঙ্গে জড়িত কিছু অসাধু ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে যাত্রীদের ঠকিয়ে আসছেন। কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন অফিসের পাশে গড়ে উঠেছে দালাল চক্রের ঘাঁটি। এই চক্রের সদস্যরা টাকা নিয়ে যাত্রীদের ভিসা ও পাসপোর্ট সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিয়ে শেষমেশ তাদের প্রতারণার শিকার করেন।
বেনাপোল ইমিগ্রেশন ইনচার্জ ইলিয়াছ হোসেন মুন্সী বলেন, ‘আগে প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ হাজার পাসপোর্টধারী যাত্রী যাতায়াত করতেন। এখন তা নেমে এসেছে হাজারের নিচে। গত ১৩ জুলাই ভারতে গেছেন মাত্র ৯৬৯ জন, ফিরেছেন ৭১৯ জন। এর মধ্যে ভারতীয় নাগরিক ছিলেন ৩২৫ জন।’
বেনাপোল বন্দরের সহকারী পরিচালক কাজী রতন বলেন, ‘যাত্রী ছাউনির জন্য জায়গা অধিগ্রহণের কাজ চলছে। ভারতীয় অংশে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যথেষ্ট গতি ও আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে যাত্রী সেবার এই দৈন্যদশা নিয়ে আলোচনার পরও বাস্তবে তেমন পরিবর্তন হয়নি।
কলকাতা থেকে মাত্র ৮৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বেনাপোল-বাংলাবান্ধা রুটটি একসময় ছিল পাসপোর্টধারী যাত্রীদের প্রধান প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় বেনাপোল হয়ে ভারতের যাত্রা আরও জনপ্রিয় হয়েছিল।
কিন্তু এখন যেভাবে যাত্রী সংখ্যা কমছে, ভিসা জটিলতা দীর্ঘ হচ্ছে, নিরাপত্তা ও সেবার ঘাটতি বাড়ছে—সবমিলে এই বন্দর তার গুরুত্ব হারাতে বসেছে। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে বেনাপোলের জায়গা নিতে পারে অন্য রুট, অথবা মানুষ বিকল্প পন্থায় যাতায়াত শুরু করবে।
বেনাপোল বন্দর শুধু একটি সীমান্ত নয়—এটি দুই দেশের মানুষের আশা, চিকিৎসা, বাণিজ্য ও আত্মীয়তার প্রবেশপথ। এই গেটে বাধা তৈরি হলে ভেঙে পড়ে শুধু পরিসংখ্যান নয়, সম্পর্কও। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে এই সংকটের সমাধান না হলে শুধু বেনাপোল নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে গোটা অঞ্চলের আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগ ও অর্থনীতি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ