
ছবি: সংগৃহীত
দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করতে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা আরও দুই মাস বা ৬০ দিনের জন্য বাড়িয়েছে সরকার।
আজ সোমবার (১৪ জুলাই) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ১৪ জুলাই থেকে পরবর্তী ৬০ দিন অর্থাৎ ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীর নির্দিষ্ট পর্যায়ের কর্মকর্তারা ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।
এই ক্ষমতা প্রয়োগ সংক্রান্ত আদেশটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার যেসব কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন, তারা এই সময়ের মধ্যে ‘বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট’ হিসেবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা লাভ করবেন।
এই তালিকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং প্রেষণে নিয়োজিত সমপদমর্যাদার কোস্ট গার্ড ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর কর্মকর্তারাও অন্তর্ভুক্ত।
তাঁরা যেকোনো এলাকায় দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক বা নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে নির্ধারিত সময়কালের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।
বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিযুক্ত সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা পরিস্থিতি বিবেচনায় দণ্ডবিধির আওতায় তাৎক্ষণিক বিচার কার্যক্রম পরিচালনা, শাস্তি প্রদান, জব্দ, অভিযান পরিচালনা, জনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, অবৈধ সমাবেশ নিয়ন্ত্রণ, কারফিউ কার্যকর, জরুরি নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নসহ আরও কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে পারবেন।
এই ক্ষমতা মূলত বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ত্বরিত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ করে দেয়, বিশেষ করে রাজনৈতিক উত্তেজনা, বড় জনসমাগম, সহিংসতার আশঙ্কা বা দুর্যোগকালীন সময়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়ার প্রয়োজন হলে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশে কয়েক দফায় রাজনৈতিক উত্তেজনা, নির্বাচনী সহিংসতা, গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্থাপনার ওপর হামলার শঙ্কা এবং নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে সশস্ত্র বাহিনীকে সীমিত সময়ের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল।
পরবর্তীতে কয়েক দফায় সেই মেয়াদ বাড়ানো হয়। আজকের ঘোষণার মাধ্যমে আবারও সেই ক্ষমতার মেয়াদ ৬০ দিন বাড়িয়ে ১৪ জুলাই থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বহাল রাখা হয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, “বিশ্বব্যাপী অনেক দেশেই জরুরি পরিস্থিতিতে সামরিক কর্মকর্তাদের অস্থায়ী বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও তা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। তবে এটি যেন নিয়মে পরিণত না হয়, সেটি নজর রাখতে হবে।”
তাঁর মতে, মাঠপর্যায়ে প্রশাসনিক দুর্বলতা কিংবা রাজনৈতিক টানাপোড়েন থাকলে বা পুলিশ বাহিনীর সক্ষমতা হ্রাস পেলে সামরিক বাহিনীকে এই দায়িত্ব দিতে হয়।
এদিকে সুশাসন ও গণতান্ত্রিক চর্চার পক্ষের সংগঠনগুলো মনে করছে, বারবার সামরিক বাহিনীর এমন ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রয়োগ প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বলতার দিকেই ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশের সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি চাইলে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে বিশেষ নির্বাহী ক্ষমতা দিতে পারেন। এ ধরনের ক্ষমতা সাধারণত সাময়িক এবং পরিস্থিতিনির্ভর হয়ে থাকে।
ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান করে কার্যত সামরিক কর্মকর্তারা মাঠে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সমানাধিকার পেয়ে থাকেন। তবে এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
সশস্ত্র বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে বরাবরই মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। একদিকে প্রশাসন ও সরকারের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এটি জরুরি সিদ্ধান্ত মনে করা হয়, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রশ্নে এই সিদ্ধান্তে শঙ্কা প্রকাশ করেন অনেকেই।
বিশেষত, বিরোধী দল ও নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলো মনে করে, এটি সাধারণ নাগরিকদের ওপর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
তবে সরকার বলছে, এটি কেবলমাত্র আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য প্রযোজ্য। কোনোভাবেই এটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা নয়।
সার্বিক বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত মূলত চলমান নিরাপত্তা প্রেক্ষাপটের অংশ হিসেবেই নেওয়া হয়েছে। তবে প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে নজর না দিয়ে যদি সামরিক বাহিনীকেই নিয়মিত নির্বাহী ক্ষমতার দায়িত্বে রাখা হয়, তাহলে তা দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসনিক ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সুতরাং এই সিদ্ধান্ত যেন কার্যকর হয় স্বচ্ছতা ও আইনের শাসনের আলোকে, তা নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ