
ছবি: সংগৃহীত
“মব ভায়োলেন্স কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জনগণ সচেতন হচ্ছে, তারাই যদি রুখে দাঁড়ায়, এই প্রবণতা আর থাকবে না।”—সোমবার (১৪ জুলাই) কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের সমন্বয় সভা শেষে এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা পরিষদের স্বরাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
সেই সঙ্গে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “কারওই হাতে আইন তুলে নেওয়ার অধিকার নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন আছে আইন প্রয়োগের জন্য। জনগণের উচিত মব জাস্টিস বা গুজবনির্ভর বিচার না করে আইনকে বিশ্বাস করা এবং অপরাধ হলে তার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে আইনগত পথে সহায়তা করা।”
সোমবার দুপুর ১২টা থেকে শুরু হয়ে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এই সভা অনুষ্ঠিত হয় কক্সবাজার বিয়াম ফাউন্ডেশন আঞ্চলিক কেন্দ্রের মিলনায়তনে। সভার মূল আলোচ্য ছিল—রোহিঙ্গা সংকট, সীমান্ত পরিস্থিতি ও কক্সবাজার অঞ্চলে মাদক পাচার ও এর বিস্তার। সভাটি মূলত ছিল একটি আন্তঃবাহিনী ও প্রশাসনিক সমন্বয় সভা, যেখানে সরকারের নীতিনির্ধারণী স্তরের পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ছাড়াও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), আনসার ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “মাদক আমাদের সমাজে নানা পথে প্রবেশ করেছে। এটি এখন শুধু আইনশৃঙ্খলা বা সীমান্ত ইস্যু নয়—এটি একটি সামাজিক দুর্যোগ। এই দুর্যোগ থেকে সমাজকে বাঁচাতে সরকার সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থান নিয়েছে।”
তিনি গণমাধ্যমের উদ্দেশে বলেন, “মাদকবিরোধী লড়াইয়ে জনসচেতনতা তৈরি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যম যদি এই বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে ভূমিকা রাখে, তাহলে সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিরোধ গড়ে উঠবে।”
উপদেষ্টা জানান, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর ভেতর এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো মাদকের প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। “এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থাকে সমন্বয় করে টাস্কফোর্স ভিত্তিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। মাদক পাচার ও চোরাচালান যেখান থেকেই আসুক, তা কঠোরভাবে দমন করা হবে।”
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “সরকার এই সংকট সমাধানে সবসময় সক্রিয় থেকেছে। কূটনৈতিক পর্যায়ে কাজের পাশাপাশি মাঠ পর্যায়েও নজরদারি ও মানবিক ব্যবস্থাপনা জোরদার করা হয়েছে। সীমান্ত নিরাপত্তার পাশাপাশি ক্যাম্পভিত্তিক অপরাধ দমনেও সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধী চক্র, মাদক চোরাচালান এবং সন্ত্রাসী তৎপরতা ঠেকাতে বিভিন্ন বাহিনীকে সমন্বিতভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ক্যাম্প ব্যবস্থাপনার মধ্যে যারা দুর্নীতি বা অব্যবস্থাপনায় যুক্ত তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কক্সবাজার জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চল—বিশেষ করে টেকনাফ, উখিয়া, ও নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম এলাকাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও আলোচনা হয় সভায়। বিজিবি ও সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ, অস্ত্র চোরাচালান এবং মাদক প্রবেশ—এই তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে এসেছে।
সভা শেষে বিকেলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পরিদর্শনে যান রোহিঙ্গা ক্যাম্প। পরে তিনি যান বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট (বিওপি)। সেখানে তিনি সামরিক ও বর্ডার নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং বাস্তব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন।
উপদেষ্টা জানান, “এই এলাকায় সর্বোচ্চ সতর্কতা ও নজরদারি বজায় রাখতে হবে। সীমান্তের কোনো ফাঁকফোকর যেন অপরাধীদের জন্য ব্যবহৃত না হয়, সেদিকে আমাদের নজর রয়েছে।”
উচ্চপর্যায়ের এই সফর ও বৈঠক সম্পর্কে প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, এটি ছিল রোহিঙ্গা সংকট, মাদক সমস্যা ও সীমান্ত নিরাপত্তা ইস্যুতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নতুন করে সক্রিয় হওয়ার একটি স্পষ্ট বার্তা। প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী ও গণমাধ্যম—সব পক্ষের সমন্বিত ভূমিকা ছাড়া এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ভাষায়, “জাতির নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ রক্ষায় এসব ইস্যুতে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ