
ছবি: সংগৃহীত
এ বছর একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশের পাঁচ শতাধিক কলেজ ও মাদ্রাসা। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ফলাফলের হার গত বছরের তুলনায় বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়ায় শিক্ষার্থী সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে উপজেলা ও মফস্বলের বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খালি আসন নিয়ে শিক্ষাবর্ষ শুরু করতে পারে, যা দেশে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) প্রকাশিত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলে দেখা গেছে, এবারের পাসের হার আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার হয়েছে মাত্র ৬৮ দশমিক ০৪ শতাংশ। গত বছর এই হার ছিল ৮৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। একইসঙ্গে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৩৮ হাজার ৮২৭ জন।
এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে একাদশ শ্রেণির জন্য সরকারি-বেসরকারি কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট আসন রয়েছে ২৭ লাখ ৬৮ হাজার ৩৪২টি। আর চলতি বছর পাস করেছে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন শিক্ষার্থী। অর্থাৎ, সব শিক্ষার্থী যদি একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়—even if none choose technical education—তবুও প্রায় ১৩ লাখ ৬৫ হাজার আসন খালি থাকবে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, শুধুমাত্র কলেজ ও মাদ্রাসাতেই আসন রয়েছে ২৬ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি। আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা এর তুলনায় অনেক কম। বাস্তবে দেখা যায়, প্রতিবছর এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীদের অন্তত ১০ শতাংশ একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয় না; কেউ প্রবাসে চলে যায়, কেউ কাজের সন্ধানে নামে, কেউ বা পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়। সেক্ষেত্রে ফাঁকা আসনের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই ধরে নিচ্ছেন নীতিনির্ধারকরা।
বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই কিছু আসন খালি থাকে। কিন্তু এ বছর ফলাফলের যে ধস নেমেছে, তাতে এই ফাঁকা আসন দ্বিগুণ বা ততোধিক হতে পারে। বিশেষ করে উপজেলা ও মফস্বল অঞ্চলের অনেক কলেজে শিক্ষার্থী সংকট চরমে উঠবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ঢাকার মত নামকরা কলেজে অবশ্য চাহিদা বরাবরই বেশি। সেসব কলেজে এবারও ভর্তি যুদ্ধে উত্তীর্ণ হতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। তবে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হচ্ছে, এবারও একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা হবে না; বরং এসএসসি ফলাফলের ভিত্তিতেই কলেজে ভর্তি হবে।
২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু হতে যাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে অনলাইনে ভর্তি আবেদন আহ্বান করা হবে। এরই মধ্যে বুয়েটের সহযোগিতায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম প্রস্তুতের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক মো. রিজাউল হক জানিয়েছেন, একাধিক বৈঠকের মাধ্যমে ভর্তি নীতিমালা চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এ সপ্তাহে আরও একটি সভা হওয়ার কথা রয়েছে। সভা শেষে মন্ত্রণালয় থেকে ভর্তি সংক্রান্ত নীতিমালা চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করা হবে।
চলতি শিক্ষাবর্ষে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয় হলো কোটা প্রথায় পরিবর্তন। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে স্মরণ করে এবারই প্রথমবারের মতো একাদশ শ্রেণিতে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান কোটা’ অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
এই কোটার আওতায় ২০২৪ সালের আন্দোলনে আহত বা শহীদদের পরিবারের সদস্যরা বিশেষ সুবিধা পাবেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এই কোটা প্রাথমিকভাবে কয়েক বছরের জন্য সীমিত আকারে রাখা হবে। পরে প্রভাব ও প্রয়োজন বিবেচনায় বিলুপ্ত করার চিন্তা রয়েছে।
অন্যদিকে, স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রায় পাঁচ দশক পর ‘মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের কোটা’ বিলুপ্তির পথে। গত বছর পর্যন্ত একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিতে ৫ শতাংশ কোটা ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য এবং ২ শতাংশ ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন দপ্তর-সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানের জন্য। শিক্ষা বোর্ডগুলোর মত অনুযায়ী, এই দুই কোটাই এবার বাতিল হতে পারে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা মনে করছেন, নাতি-নাতনির কোটা ইতিমধ্যে বাতিল হয়েছে। এখনো যারা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের কোটা দাবির পক্ষে রয়েছেন, তারা মূলত পোষ্য সুবিধা ভোগ করার আশায় আছেন। অথচ এই কোটা সংরক্ষণ করে প্রতিবছর অনেক কলেজে আসন খালি থেকে যাচ্ছে। ফলে এটি আর কার্যকর রাখার যৌক্তিকতা নেই।
যদিও কোটার সংখ্যা সামগ্রিক ভর্তি প্রক্রিয়ার মাত্র ৭ শতাংশ, তবুও এর মধ্যে যেসব আসনে শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না, তা দীর্ঘদিন খালি থেকে যায়। এবার এই আসনগুলোকে সাধারণ আসনের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর ফলাফলের প্রেক্ষিতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তাতে কোটার সংস্কার যেমন প্রয়োজনীয় ছিল, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান, অবকাঠামো এবং পাঠদানের মান নিয়েও ভাবতে হবে। কারণ, শুধু শহরকেন্দ্রিক কলেজগুলোতে ভর্তি বাড়লে আর মফস্বল অঞ্চলে প্রতিষ্ঠান খালি থাকলে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে স্পষ্ট যে, শুধু পাসের হার কমে যাওয়াই নয়—পুরো ভর্তি ব্যবস্থায় নীতিগত এবং কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। দীর্ঘদিন ধরে কিছু প্রতিষ্ঠানে আসন পূরণ না হওয়া, একই সঙ্গে নামি কলেজে অতিরিক্ত চাপ—এই দুই চিত্র উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বৈষম্য তৈরি করছে।
এই শিক্ষাবর্ষে ভর্তি প্রক্রিয়ার সময়সীমা, নীতিমালার পরিবর্তন ও কোটা সংস্কার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন দেখেই বোঝা যাবে, এই সংকট কতটা প্রশমিত হয়, নাকি আরও গভীর সংকটে প্রবেশ করে দেশের একাদশ শ্রেণির শিক্ষা ব্যবস্থা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ