
ছবি: সংগৃহীত
দেশব্যাপী নকল ও ভেজাল ওষুধের ব্যাপক বিস্তার এবং ওষুধশিল্পে ক্রমবর্ধমান নৈরাজ্যের প্রতিবেদন নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই সমস্যা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল এবং উপজেলা এলাকাগুলোতে নকল ও ভেজাল ওষুধের বেচাকেনা বেশি হচ্ছে বলে ধরা পড়েছে। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোর তুলনায় এসব অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর নয়, যার ফলে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা বেড়ে গেছে।
নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের পিছনে রয়েছে কিছু অসাধু মহল এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের যোগসাজশ। ওষুধ বিক্রেতাদের অভিযোগ, কিছু কর্মকর্তা মাসোয়ারা নিয়ে নিয়মিত এসব নকল ও ভেজাল পণ্য বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার পাশাপাশি বৈধ ওষুধ প্রস্তুতকারী ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হচ্ছে।
রাজধানীর নামী ওষুধ বিক্রয় প্রতিষ্ঠানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ ওষুধ ভেজাল ও নকল। আমদানিকৃত অনেক ওষুধের মধ্যেই নকলের ছাপ স্পষ্ট। এমনকি ইনসুলিনের মতো জীবনরক্ষাকারী ওষুধও নকল হয়ে বাজারজাত হচ্ছে। বিক্রেতারা জানান, নকল ওষুধের ক্ষেত্রে কী ধরনের রাসায়নিক বা উপাদান ব্যবহার করা হয়, তা ভেজালকারীদের কাছেও স্পষ্ট নয়। কেউ কেউ প্যাকেট করার কাজ করেন, মূল পণ্যের সঙ্গে রং এবং গুঁড়ো মিশিয়ে নকল তৈরির কৌশল অবলম্বন করেন।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে মোট ৩০২টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানির মধ্যে ২২৯টি নিয়মিত ওষুধ তৈরি করছে। অনিয়মের কারণে ৬৩টির উৎপাদন সাময়িক বন্ধ রয়েছে, ২টি কোম্পানি সম্পূর্ণ বন্ধ। যদিও বাজারে ২০-২৫টির বেশি কোম্পানির পণ্যই কম দেখা যায়, কারণ অধিকাংশ কোম্পানির উৎপাদিত নিম্নমানের ওষুধ উপজেলার গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
অর্ধশতাধিক কোম্পানি বিদেশে ওষুধ রপ্তানি করলেও বাজারে অবৈধভাবে বিক্রি হওয়া ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকায় ভেজাল ও নকল ওষুধের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানী বিশেষজ্ঞরা নকল ও ভেজাল ওষুধের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, “ভেজাল ও নকল ওষুধ ব্যবহারে রোগীর শরীরে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, যা অঙ্গহানির মতো গুরত্বপূর্ণ সমস্যায় পর্যবসিত হতে পারে।”
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. কামরুল আলম বলেন, “চিকিৎসকের প্রেস্ক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনা বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় অযাচিত ওষুধ ব্যবহার হয়ে স্বাস্থ্যহানি ঘটবে, যা আত্মঘাতী হতে পারে।”
কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, “ভেজাল ও নকল ওষুধ রোগীর কিডনি, লিভার নষ্ট করতে পারে এবং জীবনহানির ঝুঁকি বাড়ায়।”
শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শফি আহমেদ মোয়াজ বলেন, “বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে নকল ওষুধ মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে, যা জীবনহানির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।”
গাইনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুসাররাত সুলতানা সুমি বলেন, “গর্ভবতী মায়েদের জন্য নকল ও ভেজাল ওষুধ স্বাস্থ্যঝুঁকি বহন করে, যা মা ও শিশুর জীবনের জন্য মারাত্মক বিপদ।”
ডা. আয়েশা আক্তার, উপপরিচালক, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ হাসপাতাল, বলেন, “ভেজাল ও নকল ওষুধ ব্যবহারে স্বাস্থ্যহানি ও জটিলতার আশঙ্কা বেশি।”
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আশরাফ হোসেন স্বীকার করেছেন, “জনবল সীমিত হওয়ায় দেশের বিশাল ওষুধ বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠিন পরিস্থিতি। আমরা অভিযান চালাচ্ছি, তবে ব্যাপক পরিসরে নিয়মিত নজরদারি করার জনবল এখনই পর্যাপ্ত নয়।”
অন্যদিকে, ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ডা. জাকির হোসেন বলেন, “ভেজাল ও নকল ওষুধ নির্মাতা ও বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়া অপরিহার্য। দেশের ওষুধ শিল্প ও আন্তর্জাতিক বাজারের সুনাম রক্ষা করতে হবে।”
ভেজালবিরোধী আলোচিত ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, “নিয়মিত অভিযান ও কঠোর শাস্তির মাধ্যমে ভেজাল ও নকল ওষুধ নির্মাতা ও ব্যবসায়ীদের সাহস কমানো সম্ভব। কঠোর আইন প্রয়োগ হলে এই নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে আসবে।”
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু শাস্তিই নয়, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, কঠোর মনিটরিং এবং প্রযুক্তি নির্ভর সমাধান গ্রহণ করতে হবে। ল্যাব টেস্ট ও রেগুলার অডিট নিশ্চিত করতে হবে যাতে নিম্নমানের ওষুধ বাজারে আসতে না পারে।
দেশে নকল ও ভেজাল ওষুধের সমস্যা দীর্ঘদিন থেকে চলমান থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে এই সংকট আরও গুরুতর আকার ধারণ করেছে। স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধির পাশাপাশি বৈধ ব্যবসায়ীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সরকার, প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কঠোর নজরদারি, জনসচেতনতা, এবং আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে জনস্বাস্থ্য ও দেশের ঔষধশিল্প উভয়েরই বড় ক্ষতি হবে। এখন সময় এই ভয়াবহ নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই করার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ