
ছবি: সংগৃহীত
ঈদুল আজহা, ব্যাংক খাত নিয়ে গুজব এবং সামগ্রিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনৈতিক বাজারে মানুষের মধ্যে নগদ টাকার প্রতি নির্ভরতাই যেন আবারও বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০২৫ সালের মে মাস শেষে দেশে নগদ টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা—যা পূর্ববর্তী মাস এপ্রিলের তুলনায় ১৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কেবল ঈদের প্রভাব নয়; এর গভীরে রয়েছে জনগণের আস্থার সংকট, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা ও আর্থিক খাত নিয়ে ক্রমবর্ধমান শঙ্কা।
ঈদুল আজহা ঘিরে সাধারণত নগদ টাকার চাহিদা বাড়ে—কোরবানির পশু কেনা, বেতন-বোনাস এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে নগদ লেনদেনের প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে। তবে চলতি বছরে এই চাহিদার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে কিছু ব্যাংক নিয়ে ছড়িয়ে পড়া গুজব ও সংকট।
বিশেষ করে দেশের ছয়টি ইসলামী ব্যাংক একীভূত হওয়ার পরিকল্পনা এবং কিছু ব্যাংক বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে গুজব তৈরি হয় সামাজিক মাধ্যমে। এই পরিস্থিতিতে বহু গ্রাহক তাদের সঞ্চিত অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে রাখছেন হাতে হাতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “ঈদের সময় মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নগদ অর্থের দিকে ঝোঁকে। কিন্তু এবার সেটা অতিরিক্ত মাত্রায় হয়েছে, যেটি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও গুজবের ফল।”
অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাসুদা হোসেন বলেন, "সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংক খাতে অনিয়ম, খেলাপি ঋণ এবং রাজনৈতিক প্রভাব যে হারে বেড়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কিত। ব্যাংকে টাকা রাখার পরিমাণ বাড়লেও এর বড় অংশই পুনরায় তুলেও নিচ্ছে গ্রাহকরা। এটা ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য বিপজ্জনক।"
তথ্য বলছে, শুধু মার্চ মাসেই (ঈদুল ফিতরের আগে) এক মাসে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এরপর এপ্রিল মাসে তার ১৯ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকিং খাতে ফিরে এলেও মে মাসে আবার উল্লম্ফন দেখা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের ওঠানামা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদে হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত টানা ১১ মাস নগদ টাকার প্রবাহ বেড়েছিল। এরপর সামান্য কমলেও মে ২০২৫ এ আবারও তা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯২ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা, যা মে মাসে বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা।
মে মাস শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার ৬৫ কোটি টাকা, যা এপ্রিলের তুলনায় ১১ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা বেশি। বছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭.৭৩ শতাংশ। তবে সব ব্যাংকের চিত্র একই নয়। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকে আমানত প্রবাহের মধ্যে বিরাট বৈষম্য তৈরি হয়েছে।
বেসরকারি ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, "বড় ব্যাংকগুলোতে এখনও কিছুটা স্থিতিশীলতা আছে, তবে ছোট এবং কিছু ইসলামী ব্যাংকে আমানত উত্তোলনের চাপ টের পাওয়া যাচ্ছে। গ্রাহকরা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না।"
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম মনে করেন, "যখন জনগণ ব্যাংকের ওপর আস্থা হারায়, তখন অর্থনীতি দুর্বল হয়। একদিকে ব্যাংকে আমানত কমে, অন্যদিকে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই আস্থাহীনতা দূর না হলে টাকার গতিশীলতা কমে যাবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও বাজারে তারল্য ব্যবস্থাপনার ওপর।"
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সংকট নিরসনে সর্বাগ্রে প্রয়োজন স্বচ্ছতা ও নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা। গুজবের বিরুদ্ধে সরকারের স্পষ্ট অবস্থান, আর্থিক খাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কঠোর তদারকি, খেলাপি ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত একটি ব্যাংকিং পরিবেশ তৈরি না হলে ভবিষ্যতে আরো বড় সংকট তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, "জনগণের আস্থা ফিরে পেতে হলে ব্যাংকগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এখন সময়ের দাবি। আমরা যদি এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারি, তাহলে নগদ টাকার এই অস্বাভাবিক প্রবাহও কমে আসবে।"
সার্বিকভাবে, নগদ অর্থের প্রতি এই ঝোঁক আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতাকে আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। তাই এখন সময় সংকট মোকাবেলার বদলে স্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ