
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যা দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। শুক্রবার দুপুরে সরকারের প্রেস উইং থেকে দেওয়া এক লিখিত বিবৃতিতে এই বার্তা দেওয়া হয়। এটি এমন এক সময় এসেছে, যখন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগ এবং শেখ হাসিনার শাসনামলের বিরুদ্ধে ছাত্র ও তরুণদের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং জোট আন্দোলনে সরব হয়ে উঠেছে।
বিশেষ করে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে বিভিন্ন দিক থেকে চাপ প্রয়োগ করছে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’ এবং তার নেতৃত্বাধীন অন্যান্য শরিক দলগুলো। এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা বারবার দাবি করে আসছেন যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা ছাড়া দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়ের পথ উন্মুক্ত হবে না। এই দাবির প্রেক্ষিতে জনদাবি, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকার এই বিবৃতি প্রকাশ করল।
সরকার বলছে— ‘দাবি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায়’
প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে— “সম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও জনগণের পক্ষ থেকে স্বৈরশাসন ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে, তা সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। ইতোমধ্যে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ স্থাপন করেছে এবং আলোচনার ভিত্তিতে খুব দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হবে।”
এই বিবৃতি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, সরকার আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণে আর সময়ক্ষেপণ করতে চাচ্ছে না। সরকার আরও জানায় যে, ‘আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম’ নিয়ে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ ও রিপোর্ট ইতিমধ্যে সরকারের নজরে এসেছে এবং তা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ, এবার কি আওয়ামী লীগ?
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশ ছিল বিবৃতির ওই অনুচ্ছেদ, যেখানে বলা হয়েছে: “জনদাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রচলিত আইনের অধীনে সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগকে ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।”
এই ঘোষণার মাধ্যমে সরকার কার্যত স্পষ্ট করে দিল যে, ছাত্রলীগের মতো সহযোগী সংগঠনের ওপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পর এখন মূল দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে— সময়মতোই সিদ্ধান্ত আসবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আইনি সংশোধনী
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে চায়। সে লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
বিশ্লেষকদের মতে, এটি মূলত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ ব্যবস্থা গ্রহণের পথ সুগম করার একটি কৌশলগত প্রস্তুতি। কারণ, ইতিপূর্বে বিরোধী দলগুলো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ২০১৩-১৪ সালের সহিংস দমন-পীড়ন, গুম, খুন ও মানবতাবিরোধী কার্যক্রমের অভিযোগ তুলেছে।
এনসিপি, নাগরিক সমাজ ও শিক্ষার্থী আন্দোলনের চাপ
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবির পেছনে মূলত নেতৃত্ব দিচ্ছে নতুন রাজনৈতিক শক্তি— জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), যার শীর্ষে রয়েছেন ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সংগঠকরা। তারা দেশজুড়ে একের পর এক কর্মসূচি দিচ্ছেন। বৃহস্পতিবার রাতে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ‘যমুনা’র সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করেন, যা শুক্রবার সকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপি ও তাদের সহযোগী সংগঠনের ডাকা অবরোধ চলাকালে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। “বাংলাদেশ উইদাউট আওয়ামী লীগ” শ্লোগানে মুখরিত হয় শাহবাগ। এনসিপির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ঘোষণা দেন, “যতদিন না প্রজ্ঞাপন জারি করে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে, ততদিন আন্দোলন চলবে।”
উপদেষ্টা পরিষদে ঐকমত্য, জাতীয় সংলাপের প্রস্তুতি
সরকারের উপদেষ্টা পরিষদেও এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই বলে জানা গেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুলও সম্প্রতি বলেছেন, “আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থান জনবিচ্ছিন্ন, এবং দলটি নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের দাবি।”
অন্যদিকে এনসিপি নেতা রাশেদ খান জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে এ বিষয়ে একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সারজিস নামে আরেক নেতা বলেছেন, “আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে। জনগণ ফ্যাসিবাদের বিচার দেখতে চায়।”
আবদুল হামিদের দেশত্যাগ নিয়ে ক্ষোভ
এই পুরো প্রেক্ষাপটের কেন্দ্রে রয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিতর্কিতভাবে দেশত্যাগ। বিবৃতিতে এ নিয়েও সরকারের অবস্থান জানানো হয়েছে— “ফ্যাসিবাদী সরকারের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও হত্যা মামলার আসামি আবদুল হামিদের বিদেশ গমন সম্পর্কে জনমনে যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে, তা সরকার গভীরভাবে উপলব্ধি করছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়, অন্তর্বর্তী সরকার এখন কেবল আওয়ামী লীগ নয়, তাদের সম্পৃক্ত সকল সহযোগী ও সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থায় যাচ্ছে।
রাজনৈতিক টার্নিং পয়েন্ট?
বহু বিশ্লেষক মনে করছেন, এই বিবৃতির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার একটি বড় রাজনৈতিক মোড় নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেশের ইতিহাসে কোনো বড় দলকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত বিরল হলেও এখনকার প্রেক্ষাপটে তা সম্ভব বলেই অনেকে মনে করছেন। বিশেষ করে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর মূল দলের নিষিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বিবৃতির শেষাংশে সরকারের পক্ষ থেকে দেশের জনগণকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, “দেশের গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের সব সিদ্ধান্তই হবে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ