
ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। বৃহস্পতিবার (৮ মে) রাতে নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ সংক্রান্ত বিস্ফোরক মন্তব্য করেন, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে।
আসিফ মাহমুদ তার পোস্টে লিখেন, “নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ। সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই প্রসেস করে সব ফরমালিটি শেষ করে এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।”
তিনি আরও স্পষ্ট করেন, “গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নিষিদ্ধ এবং রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্নকরণ নিশ্চিত করাই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার।”
তার এই বক্তব্য ইঙ্গিত দেয়, কেবল দুইটি সহযোগী সংগঠনই নয়, আওয়ামী লীগের মূল সংগঠনের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা উড়ানো যাচ্ছে না। এর মাধ্যমে নতুন সরকারের আইন ও রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি যে আরও দূরপাল্লার, তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
নয় মাস আগে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগ এক ধরনের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক সংকটে রয়েছে। একের পর এক দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-খুনের অভিযোগ ও স্বজনপ্রীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে দলটি রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এসবের প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে দলটির আইনগত বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে এই দুটি সংগঠনকে ঘিরে চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, অস্ত্রের প্রদর্শনী এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বহু মামলা, তদন্ত ও আন্দোলন হয়েছে। এখন সেই অভিযোগগুলোর কার্যকর পরিণতি ঘটানোর পথে এগোচ্ছে সরকার।
আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত বুধবার (৭ মে) দিবাগত রাত ৩টা ৫ মিনিটে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে দেশত্যাগ করেন। তার এভাবে হঠাৎ বিদেশে পাড়ি জমানো নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের অতীত শাসনামল, জবাবদিহি ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে একটি আন্দোলন চলছে। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ‘যমুনা’-র সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। পুলিশি ব্যারিকেড ভেঙে শত শত ছাত্র-জনতা সেখানে অবস্থান নিয়ে “আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করো, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করো” স্লোগানে মুখরিত করে তুলেছে এলাকা।
এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, বামপন্থী দল, মানবাধিকার কর্মী ও কিছু ধর্মভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম। অবস্থানরত আন্দোলনকারীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ এবং তার অনুগত সংগঠনগুলোকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো না হলে দেশ কখনোই প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাদ পাবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষকরা মনে করছেন, এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার মূলত দুর্বৃত্তায়নের দায়ে অভিযুক্ত রাজনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে এক ধরনের শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে। তারা বলছেন, যদি যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, তবে তার রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংগঠনিক প্রভাব হবে ব্যাপক। এটি কেবল আওয়ামী লীগের শক্তি খর্ব করবেই না, দেশের রাজনীতিতে এক নতুন বাস্তবতার সূচনা ঘটাবে।
তবে এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ বা তাদের বর্তমান সমর্থক মহল থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখনো পাওয়া যায়নি। তবে দলের একাধিক সাবেক নেতা জানিয়েছেন, এসব পদক্ষেপ দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার অংশ হতে পারে।
যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নিষিদ্ধকরণের আইনি কার্যক্রম ইতোমধ্যেই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে যেভাবে আসিফ মাহমুদ দাবি করেছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে সিদ্ধান্ত আসন্ন। সরকারি গেজেট প্রকাশ, সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধে মাঠপর্যায়ের নির্দেশনা এবং সম্পদ জব্দের উদ্যোগ—সবই এখন সময়ের অপেক্ষা।
এই পদক্ষেপ কার্যকর হলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হতে যাচ্ছে—যা ইতিহাসে নজিরবিহীন।
এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কি আদৌ দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রতিষ্ঠা সম্ভব, না কি এটি এক নতুন ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বের সূচনা—তা এখন সময়ই বলে দেবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ