
ছবি: সংগৃহীত
দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো ও ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে অন্তর্বর্তীকালীন ঐকমত্য কমিশন। এই প্রক্রিয়ায় কেউ—যথা প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও—আইনের ঊর্ধ্বে যেন না ওঠে, সেই নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যেই কমিশন অগ্রসর হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন কমিশনের সহ-সভাপতি, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিদ ড. আলী রীয়াজ।
বৃহস্পতিবার (৮ মে) সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে ভাসানী জনশক্তি পার্টির সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় এ বক্তব্য দেন ড. রীয়াজ। দীর্ঘ বৈঠকে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, প্রশাসনিক কাঠামো এবং নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণে সম্ভাব্য রূপরেখা নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিত করার পক্ষে ঐকমত্য
বক্তব্যের শুরুতেই ড. রীয়াজ বলেন, “একজন ব্যক্তি যদি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বেও থাকেন, তারও যেন ক্ষমতা সীমাহীন না হয়, এবং তিনি যেন আইনের ঊর্ধ্বে না উঠতে পারেন—এই নীতিগত অবস্থান থেকেই আমরা নতুন রাষ্ট্র কাঠামোর চিন্তা করছি। অতীতে আমরা দেখেছি, কীভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন কাঠামো ধীরে ধীরে ফ্যাসিবাদে রূপ নেয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে কমিশন এমন একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে কাজ করছে, যেখানে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ এবং সর্বোচ্চ জবাবদিহিতা নিশ্চিত থাকবে।”
তিনি আরও বলেন, “ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর আমাদের দায়িত্ব হলো এমন এক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা, যা গণতন্ত্রকে টেকসই করে এবং তরুণ প্রজন্মকে আর যেন বারবার রাজপথে জীবন দিতে না হয়।” তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “নতুন কাঠামো শুধু সরকার নয়, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও সংসদের মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্যও নিশ্চিত করবে।”
কাঠামোগত সংস্কার ও জবাবদিহিতার উপর জোর
ড. রীয়াজ জানান, কমিশন এমন একটি কাঠামোর পক্ষে কাজ করছে যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরেই জবাবদিহিতা থাকবে। তিনি বলেন, “আমরা শুধু নাম পরিবর্তনের সংস্কারে আগ্রহী নই, বরং রাষ্ট্রের গভীর কাঠামোগত রূপান্তরের কথা ভাবছি। যেখানে জনগণই হবে প্রকৃত ক্ষমতার উৎস।”
ভাসানী জনশক্তি পার্টির অবস্থান ও প্রস্তাব
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ভাসানী জনশক্তি পার্টির আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু। তিনি বৈঠকে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, “আমরা একটি আদর্শভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই, যেখানে জাতীয় বীরদের যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হবে, এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে একটি আধুনিক ও ন্যায়ের রাষ্ট্র গড়ে উঠবে।”
তিনি জানান, তাঁদের দল ইতোমধ্যে একটি সংস্কার প্রস্তাবনা প্রণয়ন করেছে, যাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন ও নির্বাচনব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তনের সুপারিশ রয়েছে। এসব প্রস্তাব তারা ঐকমত্য কমিশনের কাছে তুলে ধরেন।
ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা
ড. রীয়াজ আরও বলেন, “যেভাবে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটেছে, ঠিক সেভাবেই আমাদের ঐক্য ধরে রেখে ভবিষ্যতের পথ রচনা করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যা আর কখনো স্বৈরশাসনকে আমন্ত্রণ জানাবে না।”
বৈঠকে অন্যান্য নেতারাও বলেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নতুন রাজনৈতিক চুক্তি—যেখানে ক্ষমতা জনগণের কাছে ফেরত যাবে, নির্বাচন কমিশন হবে পুরোপুরি স্বাধীন, এবং বিচার বিভাগ হবে নিরপেক্ষ।
কমিশনের কাজ ও আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ
ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্ব এখন শুধু একটি নিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়ন নয়, বরং একটি টেকসই ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। সে লক্ষ্যেই চলছে সারাদেশে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও নাগরিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক।
সংবিধান প্রণয়নের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সংস্কার, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, স্বতন্ত্র দুর্নীতি দমন কমিশন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রপতির প্রতীকী ক্ষমতার গ্যারান্টির বিষয়গুলোও আলোচনায় উঠে আসছে বলে জানা গেছে।
ড. রীয়াজ বলেন, “এই ঐক্যমত্য প্রক্রিয়া কেবল দলীয় মতবিরোধ মেটানোর প্রচেষ্টা নয়, বরং এটি একটি নূতন রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ, যাতে জনগণের আত্মত্যাগের সঠিক প্রতিদান দেওয়া যায়।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ