
ছবি: সংগৃহীত
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে তৎপর হয়ে উঠেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে একযোগে ৫১ জন নির্বাচন কর্মকর্তাকে বদলি করেছে সংস্থাটি। এমন পদক্ষেপকে নির্বাচনী প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা, যা ভবিষ্যৎ ভোট গ্রহণকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ শহীদুর রহমান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বদলির বিষয়টি জানানো হয়। এতে দেশের বিভিন্ন থানা ও উপজেলা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন কর্মকর্তাদের নতুন কর্মস্থলে বদলি করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, বদলিকৃত ৫১ কর্মকর্তাকে আগামী ২২ জুলাইয়ের মধ্যে নিজ নিজ বর্তমান কর্মস্থল থেকে অবমুক্ত হতে হবে। অন্যথায়, ২৩ জুলাই থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অবমুক্ত হিসেবে গণ্য হবেন তারা।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, পল্লবী থানা নির্বাচন কর্মকর্তা মোসাম্মৎ রাজিয়া সুলতানা, ডেমরা থানা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আহসান হাবীব এবং কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. সাহিদ হোসেন—এই তিনজনের বদলির প্রাথমিক আদেশে কিছু সংশোধনী এনে তা পুনঃজারি করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বদলির পেছনে মূল লক্ষ্য হলো নির্বাচন ঘিরে মাঠ প্রশাসনে সুসমন্বয়, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। অতীতে যেসব জায়গায় কোনো অনিয়ম বা পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছিল, সেখানে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের বদলি করেই নতুন মনোভাবে কাজ শুরু করতে চায় কমিশন।
কমিশনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, "এই রদবদলের মাধ্যমে ইসি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে চাইছে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থাকা ব্যক্তিদের ঘুরিয়ে আনা হচ্ছে যাতে পক্ষপাতের আশঙ্কা না থাকে।"
নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, “নির্বাচনের আগে এমন ধরনের বদলি একটি স্বাভাবিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়া। তবে এই বদলির উদ্দেশ্য যদি নির্বাচনকে নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করার হয়, তাহলে এটি অবশ্যই প্রশংসনীয়।”
তিনি আরও বলেন, “সততা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হলে শুধু বদলি নয়, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও স্বচ্ছ মনিটরিং ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে।”
নির্বাচন গবেষক ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দলীয় প্রভাবমুক্ত একটি নির্বাচন আয়োজনের জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা বদলি করা যৌক্তিক। তবে এই বদলি যেন রাজনৈতিক চাপ বা পক্ষপাতের ভিত্তিতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।”
সরকারি সূত্র জানায়, এটি একক কোনো পদক্ষেপ নয়—এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন সারাদেশে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে কৌশলগত পুনর্বিন্যাস শুরু করেছে। মাঠ প্রশাসনের পাশাপাশি ইসি নিজস্ব জনবল কাঠামোতেও রদবদল আনার চিন্তা করছে। ধারণা করা হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে আরও ১০০-১৫০ কর্মকর্তাকে রোটেশনাল পদ্ধতিতে বদলি করা হতে পারে।
ইসি সচিবালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, “আমরা নির্বাচনের আগে এমন এক কাঠামো তৈরি করতে চাই যাতে নির্বাচনের দিন ভোটাররা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিতে পারেন। এই বদলি সে পরিকল্পনারই অংশ।”
উল্লেখ্য, গত কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মাঠ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে একাধিকবার প্রশ্ন উঠেছে। ভোট কারচুপি, সহিংসতা, পক্ষপাতমূলক আচরণ এবং ফলাফলে হস্তক্ষেপের অভিযোগে বহু কর্মকর্তা বিতর্কিত হয়েছেন। তাই এবার আগেভাগেই নির্বাচন কমিশন এই রদবদলের উদ্যোগ নিয়ে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “কেবল বদলি করলেই হবে না, কারা কোথায় যাচ্ছেন, তাদের অতীত কাজের অভিজ্ঞতা কেমন—তা যাচাই করে দায়িত্ব দিতে হবে।”
ইসি প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, “জনস্বার্থে এ আদেশ জারি করা হলো।” অর্থাৎ, এই বদলিকে কেবল প্রশাসনিক নয়, বরং বৃহত্তর জনগণের স্বার্থরক্ষায় একটি পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
একযোগে ৫১ নির্বাচন কর্মকর্তার বদলি নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। যদিও এই বদলিকে প্রশাসনিক রুটিন কার্যক্রম বলা হচ্ছে, তবুও এটি আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কমিশনের সক্রিয় অবস্থান এবং নিরপেক্ষতা রক্ষার অঙ্গীকারেরই ইঙ্গিত বহন করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র বদলি নয়—সুশৃঙ্খল মনিটরিং, স্বচ্ছ প্রশিক্ষণ, কঠোর বিধিবিধান এবং রাজনীতির প্রভাবমুক্ত একটি নির্বাচন আয়োজন করলেই জনগণের আস্থা ফিরে আসবে কমিশনের ওপর। সেই পথেই হয়তো একধাপ এগিয়ে গেল নির্বাচন কমিশন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ