
ছবি: সংগৃহীত
হাসিনা সরকারের পতনের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে দেশের জনগণের প্রত্যাশা ছিল বিশাল। ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালের আগস্টে গঠিত এ সরকারকে অনেকেই দেখেছিলেন দীর্ঘকালীন স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠার একমাত্র সুযোগ হিসেবে। কিন্তু সরকারের আট মাস পূর্ণ হতে না হতেই প্রশ্ন উঠেছে—এই সরকার কেন কাঙ্ক্ষিত রূপান্তর ঘটাতে পারছে না?
এই প্রশ্নের উত্তরে সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একটি বিশ্লেষণধর্মী ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন, যেখানে তিনি সরকারের সীমাবদ্ধতা, ক্ষমতার জটিল বাস্তবতা, ছাত্রদের বিভক্তি, এবং পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামোর প্রভাব তুলে ধরেছেন। পোস্টের শিরোনাম ছিল—‘কৈফিয়ত কিংবা বাস্তবতা’।
ক্ষমতার ছায়া-ভরকেন্দ্র এবং সরকারের অকার্যকারিতা
মাহফুজ আলম পোস্টে বলেন, বর্তমান সরকারের হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব থাকলেও বাস্তব ক্ষমতা ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন “ভরকেন্দ্রে”—যেমন প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ, এমনকি মিডিয়া ও ব্যবসায়িক মহলে। তার ভাষায়, “ক্ষমতার ভরকেন্দ্র অনেকগুলো। ফলে কাজের দায় সরকারের, কিন্তু কাজ করে ক্ষমতার অন্যান্য ভরকেন্দ্র।” এই ছায়া-ভরকেন্দ্রগুলোর সাথে সমন্বয়হীনতা এবং দ্বিদলীয় স্বার্থান্বেষীদের সক্রিয় উপস্থিতি সরকারের কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক দল ও এস্টাবলিশমেন্টের দ্বিচারিতা
তথ্য উপদেষ্টার মতে, সরকার গঠনের পর ডিসেম্বর থেকেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতার ভূমিকায় ছিল না। তবে প্রশাসন, পুলিশ, এবং বিচার বিভাগে তারা এখনও “স্টেইক” ধরে রেখেছে। তিনি আরও বলেন, এস্টাবলিশমেন্ট এখনো ছাত্র রাজনীতিকে মাইনাস করে পুরাতন দ্বিদলীয় কাঠামোতে ফেরার প্রয়াস চালাচ্ছে।
ছাত্র প্রতিনিধিত্বহীনতা ও নেতৃত্ব সংকট
পোস্টে মাহফুজ অভিযোগ করেন, সরকারের মধ্যে ছাত্র প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত কম। প্রায় তিন ডজন উচ্চপদস্থ নিয়োগপ্রাপ্তের মধ্যে ছাত্র আন্দোলন থেকে এসেছে মাত্র দুজন। এদেরকেও বিভিন্নভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। এতে অভ্যুত্থানের প্রধান চালিকাশক্তি—ছাত্র সমাজ—সরকারে কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারছে না।
তিনি বলেন, “আমরা দু’জন সর্বোচ্চ ব্যালেন্সিং এক্ট করতে পারছি, কিন্তু প্রভাবক হিসাবে কাজ করতে হলে সরকারে সুষম ছাত্র প্রতিনিধিত্ব লাগবে।”
বিভক্ত ছাত্র রাজনীতি এবং অভ্যুত্থানের স্থবিরতা
মাহফুজ আলম আরও জানান, ছাত্রদের বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে অভ্যুত্থানের পরিসমাপ্তি ব্যাহত হয়েছে। “বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্ম” দেশব্যাপী সংগঠিত আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে। শাহবাগ ও শাপলা চত্বরে দুই বিপরীত মতবাদের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব এই বিভাজনকে স্থায়ী করে তুলেছে।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের পক্ষের প্রতিষ্ঠান ও নতুন সিভিল সোসাইটি গড়তে ব্যর্থ হয়েছে।” ফলে অভ্যুত্থান শহর থেকে গ্রামমুখী হয়নি এবং রাষ্ট্র কাঠামোর মূল স্তরে তাদের অবস্থান জোরালো হয়নি।
রাজনৈতিক অর্থনীতি ও বিচার বিভাগের পুরনো কাঠামো অটুট
তথ্য উপদেষ্টা অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের আমলে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক অর্থনীতিতে এখনও হাত দেওয়া সম্ভব হয়নি। একইভাবে বিচার বিভাগও দ্বিদলীয় শৃঙ্খলের বাইরে যেতে পারেনি। তার মতে, “পুরাতন দ্বিদলীয় বন্দোবস্ত টিকে গেছে।”
এছাড়া, মিডিয়া ও ব্যবসায়ী মহলে আওয়ামী লীগের আগের আধিপত্য এখনো বিদ্যমান, যা তথ্য প্রবাহ এবং অর্থনীতির স্বচ্ছতা ব্যাহত করছে।
বাম-ডান ব্যর্থতা এবং ছাত্রদের হতাশা
মাহফুজ জানান, বামপন্থীরা শুরু থেকেই সরকারকে সন্দেহের চোখে দেখেছে এবং বাস্তব অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেনি। অন্যদিকে ডানপন্থীরা আবেগের বশে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ফলে রাজনীতিতে কোনও সুসংহত বিকল্প কাঠামো গড়ে ওঠেনি।
ছাত্র নেতৃত্বের মধ্যেও স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার সংকট দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, “সবচেয়ে ডেডিকেটেড ছাত্রকর্মীরা ক্রেডিট, দলবাজি আর কোরামবাজির খপ্পরে পড়েছেন। কিছু হাতে গোনা ব্যক্তির বিরুদ্ধে আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ থাকলেও, তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সমগ্র ছাত্র সমাজের উপর।”
অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার কারণ ও করণীয়
তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সাফ জানিয়ে দেন, শহিদ-আহতদের ন্যায়বিচার এবং অপরাধীদের শাস্তির ক্ষেত্রে সরকারসহ সব অংশীজন ব্যর্থ হয়েছে। অভ্যুত্থানকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি। এই ব্যর্থতার জন্য তিনি রাজনৈতিক দল, এস্টাবলিশমেন্ট, ছাত্র সমাজ—সব পক্ষকেই দায়ী করেছেন।
তিনি লিখেছেন, “ছাত্রদের ব্যর্থতা অনস্বীকার্য বটে। কিন্তু এস্টাবলিশমেন্ট দ্বিদলীয় বন্দোবস্তে ফেরার জন্য তাদের বাদ দিয়ে দেওয়ার পথেই এগোচ্ছে।”
পোস্টটি সম্পূর্ণ পড়তে ক্লিক করুন
সমাধানের দিকনির্দেশনা
সবশেষে মাহফুজ আলম তাঁর পোস্টে একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেন: “সমাধান? রাষ্ট্র ও এস্টাবলিশমেন্টে ছাত্রদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা এবং ফ্যাসিবাদী শক্তি ও তার দালালদের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আঘাত করা।”
তবে এর পূর্বশর্ত হিসেবে তিনি ছাত্র সমাজের মধ্যে আদর্শ, সততা, নিষ্ঠা এবং ঐক্য ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দেন। সেইসাথে পুরনো রাজনীতির প্রতিনিধি—দুই দলীয় শৃঙ্খলের ‘সৈনিক’দের—অকার্যকর করে দেওয়ার আহ্বান জানান।
এই পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। অনেকেই এটিকে অন্তর্বর্তী সরকারের অভ্যন্তরীণ সংকট ও ভবিষ্যৎ পথ খোঁজার একটি সাহসী স্বীকারোক্তি হিসেবে দেখছেন। তবে কেউ কেউ বলছেন, কথায় নয়—সরকারের উচিত এখন দ্রুত ফলপ্রসূ কাজ শুরু করা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ