
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে এসেছে। বিশেষত, খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর ফলেই এই কমতির পরিমাণ লক্ষ্যণীয় হয়েছে। যদিও দেশের অর্থনীতির জন্য এই পরিসংখ্যান কিছুটা আশাব্যঞ্জক, তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে এই হ্রাসটি টেকসই নয়, এবং গঠনমূলক অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো এখনও সমাধান হয়নি।
বিবিএস-এর তথ্যে জানা গেছে, এপ্রিল মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা গত মার্চে ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা মার্চ মাসে ছিল ৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এটি গত কয়েক মাসের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির সবচেয়ে কম হার, এবং এই প্রবণতা জুন পর্যন্ত থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন।
এছাড়া খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি গত মাসের ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ থেকে সামান্য কমে ৯ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমেছে। বিশেষত ঈদ পরবর্তী সময়ে চাহিদার হ্রাস এবং বাজারে পণ্যের সরবরাহের উন্নতি এর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ঈদুল ফিতরসহ অন্যান্য উৎসব-পরবর্তী সময়ে সাধারণত মানুষের ব্যয় সংকুচিত হয় এবং বাজারে চাহিদার পরিমাণ কমে যায়, যা মূল্যস্ফীতির হ্রাসে সহায়তা করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির কঠোরতা, সরকারি বাজার নীতি এবং সরবরাহে কিছুটা স্থিতিশীলতার প্রভাবও এই হ্রাসের কারণ হতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মন্তব্য করেছেন, “এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে, তবে এটি খুবই সামান্য পরিবর্তন। এই হ্রাসটি কিছুটা উৎসব পরবর্তী ব্যয়ের কমতির কারণে হলেও ভবিষ্যতে আরও বড় আছড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেছেন, “যদিও মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে, তবে এটি একেবারেই সুখকর নয়। এক সপ্তাহের মধ্যে দাম আবার বাড়তে শুরু করতে পারে। আমাদের মূল্যস্ফীতির মূল সমস্যাগুলো গঠনমূলক এবং কাঠামোগত, যেগুলো এখনও সমাধান হয়নি। খাদ্যপণ্যের দাম কেবল সরবরাহের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু আমাদের দেশের বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহের সমস্যা অনেক বেশি।“
এছাড়া, তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, মুদ্রানীতির মাধ্যমে শুধুমাত্র চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়; সরবরাহ বৃদ্ধির দিকে আরও নজর দিতে হবে। রমজান মাসের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “যখন বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি পায়, তখন মূল্যস্ফীতি কমে। এটি প্রমাণ করে যে সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে এলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী মার্চের মধ্যে পলিসি রেট সাত শতাংশে কমানোর চিন্তা করতে পারে। তবে সেলিম রায়হান এই মতের বিরোধিতা করে বলেন, “আগামী মার্চ অনেক দূরে, এবং এর মধ্যে বাজারের পরিস্থিতি বদলাতে পারে। আমি মনে করি না, বর্তমান পরিস্থিতিতে পলিসি রেট কমানো কোনো সুফল বয়ে আনবে।”
তিনি আরও বলেন, “এমনকি পলিসি রেট কমালেও বিনিয়োগ বাড়ানোর সম্ভাবনা কম। আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত সমস্যা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা। মুদ্রানীতির দৃষ্টিকোণ থেকে, বর্তমান হার ধরে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।”
সেলিম রায়হান দেশের বাজারে বিভিন্ন চাঁদাবাজি ও কারসাজির বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “রমজান মাসে যখন বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছিল, তখন কিছু বড় আমদানিকারককে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সেইসময় যদি সঠিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।” তিনি বলেন, “সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করা, ট্যাক্স বিষয়ক সমস্যা সমাধান এবং বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে টেকসই অগ্রগতি সম্ভব হবে।”
সাম্প্রতিক এই পরিসংখ্যানগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কিছুটা স্বস্তির হলেও গঠনমূলক সমস্যা এবং সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতির অভাব এখনও সমাধান না হলে মূল্যস্ফীতি কমানোর প্রক্রিয়া অস্থায়ী থাকতে পারে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, আগামী কিছু মাসের মধ্যে যদি সরবরাহ পরিস্থিতি এবং বাজারের কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন না ঘটে, তাহলে মূল্যস্ফীতি আবার বাড়তে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ