ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন দিকচিহ্ন হয়ে থাকল ২০২৫ সালের ১০ মে রাত। ঐদিন সরকার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করেছে। সংশোধিত এই আইনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে আন্তর্জাতিক অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সংশোধনীতে এমনকি সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত, নিবন্ধন বা লাইসেন্স বাতিল এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিধান রাখা হয়েছে—যা দেশের রাজনৈতিক ও আইনি অঙ্গনে গভীর আলোড়ন তুলেছে।
সরকারি গেজেটে জানানো হয়, সংবিধানের ৯৩ (১) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন “আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (দ্বিতীয় সংশোধনী) অর্ডিন্যান্স, ২০২৫” জারি করেছেন। এই অধ্যাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধে সংশ্লিষ্ট সংগঠনসমূহের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুস্পষ্ট আইনগত ভিত্তি দেওয়া হয়েছে।
এই সংশোধনী পাশের আগে ১০ মে শনিবার রাতে রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সামরিক, আইন, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানান, জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত কথিত গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগকে বিচারের আওতায় আনতেই এই সংশোধনী আনা হয়েছে।
সংশোধিত আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো—ব্যক্তিগতভাবে নয়, বরং দলীয়ভাবে সংগঠনকেও ট্রাইব্যুনালের বিচারের আওতায় আনা। অর্থাৎ কোনো রাজনৈতিক দল বা তার অঙ্গ সংগঠন যদি প্রমাণিতভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধে লিপ্ত হয়ে থাকে—যেমন গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ, জাতিগত নিধন বা নির্যাতন ইত্যাদি—তাহলে সেই সংগঠনকেই শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে, “যদি ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রতীয়মান হয় যে কোনো সংগঠন আন্তর্জাতিক অপরাধে জড়িত ছিল, তাহলে সে সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত বা নিষিদ্ধ করা, নিবন্ধন বা লাইসেন্স বাতিল করা, এমনকি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার ট্রাইব্যুনাল পাবে।”
এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক দলকে কেন্দ্র করে এ রকম শাস্তিমূলক পদক্ষেপের জন্য প্রথম কোনো আইনি কাঠামো গড়ে তোলা হলো।
ড. আসিফ নজরুল জানান, “এই আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। বিচার চলাকালে দলটির সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। বিশেষ করে সাইবার জগতে তাদের প্রচার-প্রচারণা, বক্তব্য, রিক্রুটমেন্ট ও তহবিল সংগ্রহের যেকোনো প্রচেষ্টা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।”
এছাড়া দলটির অফিস, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নজরদারিতে আনা হবে। আইনের আলোকে এসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়াও শুরু হতে পারে।
নতুন আইনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—দল বা সংগঠনের পাশাপাশি তার সদস্য বা সমর্থক গোষ্ঠী যদি আন্তর্জাতিক অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি অপরাধে সহায়তা, নির্দেশনা, প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র বা সরাসরি অংশগ্রহণ করে থাকেন, তাহলে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যাবে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি দলীয় দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ, কারণ অতীতে ব্যক্তির বিচারের ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি থাকলেও দলীয়ভাবে কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। গত জুলাইয়ে ‘আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকার পতনের ডাক’ দিয়ে মাঠে নামে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তবে আন্দোলনের সময় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা ও সাধারণ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটায় ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো এসব ঘটনাকে “রাজনৈতিক সহিংসতা” হিসেবে চিহ্নিত করলেও, নতুন অন্তর্বর্তী সরকার একে “গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ” হিসেবে উল্লেখ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অভিযোগকে আইনি কাঠামোতে আনতে করেই সরকার এই সংশোধনী এনেছে।
ট্রাইব্যুনাল আইনের এই সংশোধনী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা গভীরভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানা গেছে। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে—এই আইনের যেন রাজনৈতিক প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না হয়।
অন্যদিকে, যুদ্ধাপরাধের দায়মুক্তির সংস্কৃতির অবসান হিসেবে অনেকেই এ আইনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদক্ষেপ সত্যিকার অর্থে ইতিহাসের দায়মুক্তি ও রাজনৈতিক জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে, যদি তা স্বচ্ছতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগে পরিচালিত হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের মাধ্যমে সরকার শুধু একটি আইন পরিবর্তন করেনি—বরং বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী অধ্যায় শুরু করল। প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়াতে যাচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, এই আইন বাস্তবে কেমনভাবে প্রয়োগ হয় এবং এর মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা কতটা নিশ্চিত করা যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



