
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনর্গঠনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী নিয়ন্ত্রণকে চিহ্নিত করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ যদি স্বাধীন না হয়, তাহলে গণতন্ত্র শুধু মুখের কথা হয়ে থাকবে। কার্যত তখন একটি কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাই কায়েম থাকে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে নির্বাহী বিভাগের একচ্ছত্র আধিপত্য।
রোববার রাজধানীর মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক আলোচনা সভায় বক্তব্য প্রদানকালে তিনি এই মন্তব্য করেন। ‘রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো সংস্কার’ বিষয়ক নাগরিক উদ্যোগ, নাগরিক কোয়ালিশন এবং সংবিধান সংস্কার নাগরিক জোট আয়োজিত এই সভায় বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে বিশেষজ্ঞরা মতামত দেন।
সংবিধানে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ ছিল—আলী রীয়াজ
ড. আলী রীয়াজ বলেন, “শুধু বর্তমান পরিস্থিতি দেখে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নির্মাণ করা যাবে না। আমাদের অতীত এবং ভবিষ্যৎ উভয়কে বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্রের কাঠামো নতুন করে গঠন করতে হবে।” তিনি মন্তব্য করেন, সংবিধানের মধ্যেই এমন ফাঁকফোকর ছিল, যা একজন নেত্রীকে (শেখ হাসিনাকে ইঙ্গিত করে) স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে আইনি সুযোগ দিয়েছে।
তিনি বলেন, “সংবিধানের মধ্যে শেখ হাসিনা তৈরি করতে কোনো বাধা ছিল না। সাংবিধানিকভাবেই তিনি স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছেন। এটি এমনভাবে রচিত হয়েছিল যে, একজন ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাইলে গণতন্ত্রের অবয়ব রেখে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে।”
“নতুন রাষ্ট্র গঠনে শহীদদের প্রতি দায় রয়েছে”
আলোচনায় অংশ নিয়ে আলী রীয়াজ ২০২৩ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “জুলাই আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন, তাদের রক্ত বৃথা যাবে না বলেই আমরা বিশ্বাস করি। তাদের ত্যাগের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই নতুন রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা আমাদের চালিয়ে যেতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে একটি আধুনিক রিপাবলিক গঠনের স্বপ্ন দীর্ঘদিন ধরে লালিত হচ্ছে। কিন্তু একচ্ছত্র নির্বাহী ক্ষমতা, দলীয় নিয়ন্ত্রণাধীন সংসদ এবং নিয়ন্ত্রিত বিচার ব্যবস্থা এই স্বপ্নকে প্রতিনিয়ত ব্যর্থ করে দিচ্ছে। তাই রাষ্ট্রের কাঠামো নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজনীয়তা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
সাত দফা প্রস্তাবের ভিত্তিতে গণতন্ত্র পুনর্গঠনের আহ্বান
আলোচনা সভায় ‘গণতান্ত্রিক কাঠামো সংস্কার’-এর জন্য নাগরিক সমাজের তিনটি প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে সাতটি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। এসব প্রস্তাবের মূল প্রতিপাদ্য ছিল—নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার, সংসদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা, নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য, মানবাধিকার রক্ষা, তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা এবং সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুসংহত করা।
ড. আলী রীয়াজ এই সাত দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, এগুলো বাস্তবায়ন হলে কেবল একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব হবে। বিশেষ করে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া এসব সংস্কারের কোনো কার্যকর ফল আসবে না বলেই তিনি সতর্ক করেন।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন
বিচার বিভাগের ওপর সরকারের প্রভাব প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, “বিচার বিভাগকে স্বাধীন করার ইচ্ছা যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বের না থাকে, তাহলে যতো আইনই করা হোক না কেন, সেগুলো কার্যকর হবে না।”
তিনি অভিযোগ করেন, দেশে বিদ্যমান কাঠামো বিচারকদের নিযুক্তি, বদলি ও পদোন্নতিতে সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে, যা কার্যত বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বতন্ত্রতা ধ্বংস করে দেয়।
আলোচনায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য বক্তারাও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও সংসদীয় কার্যপ্রণালির সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তারা বলেন, নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন সম্ভব নয়।
সভায় শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ