
ছবি: সংগৃহীত
ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনার মধ্যেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সূচিতে অনিশ্চয়তার ছায়া পড়েছে। এই উত্তপ্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের আসন্ন পাকিস্তান সফর নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে। নিরাপত্তা, কূটনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং খেলোয়াড়দের শারীরিক-মানসিক সুস্থতা—এই তিনটি প্রধান বিবেচনায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এখনো পাকিস্তান সফর নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে বিসিবি, এবং তারা জানাচ্ছে, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে সময়োপযোগী ও সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে।
যুদ্ধবিরতির পরও অনিশ্চয়তায় ক্রিকেট
ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে বহু প্রাণহানি এবং নিরাপত্তাজনিত শঙ্কা দেখা দেওয়ার পর দুই পক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। যদিও এই ঘোষণাটি কূটনৈতিকভাবে স্বস্তিদায়ক, তবে মাঠপর্যায়ে এর কতটা প্রতিফলন ঘটবে এবং পরিস্থিতি কতটা স্থিতিশীল থাকবে—সেই প্রশ্ন এখনো থেকে যাচ্ছে। ঠিক সেই কারণেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড পাকিস্তান সফর নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিয়ে ধীরে এবং সতর্কভাবে এগোতে চাইছে।
বিসিবির একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “আমরা সব দিক বিবেচনায় নিয়ে চলছি। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এসেছে, এটা ভালো খবর। কিন্তু এখনও মাঠে বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। তাই এখনই সফর নিয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা সঠিক হবে না।”
বিসিবি সভা ও আমিরাত সফরের সিদ্ধান্ত
শনিবার বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় পাকিস্তান সফর ছাড়াও সামনে থাকা সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর নিয়েও আলোচনা হয়। সভার পর বিসিবি জানিয়েছে, বাংলাদেশ দল নির্ধারিত সময়েই সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাবে এবং ১৭ ও ১৯ মে দুটি আন্তর্জাতিক টি-২০ ম্যাচ খেলবে। এই সফরের জন্য ১৪ মে দেশ ছাড়বে টাইগাররা।
তবে পাকিস্তান সফর নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। বিসিবি জানিয়েছে, সফরের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তারা পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছ থেকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণের অপেক্ষা করবে। কারণ এই সফর শুধুমাত্র খেলাধুলার বিষয় নয়—এটি জাতীয় নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং দেশের ক্রিকেটারদের শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বিসিবির আনুষ্ঠানিক বিবৃতি
শনিবার রাতে বিসিবি এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়:
"বাংলাদেশ দলের আসন্ন পাকিস্তান সফর নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এবং পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) এর মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। বিসিবি আবারও জোর দিয়ে জানাচ্ছে, খেলোয়াড় এবং সাপোর্ট স্টাফদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সর্বদা বোর্ডের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে সফর সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্তই সতর্কতার সঙ্গে নেওয়া হবে এবং তা দল ও বাংলাদেশ ক্রিকেটের সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিত করা হবে।"
সূচি অনুযায়ী প্রস্তুতি, কিন্তু সিদ্ধান্ত স্থগিত
পাকিস্তান সফরের সম্ভাব্য সূচি অনুযায়ী, বাংলাদেশ দলের ২৫, ২৭ ও ৩০ মে এবং ১ ও ৩ জুন মোট পাঁচটি ম্যাচ খেলার কথা রয়েছে। তবে বিসিবি এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিয়ে আরও কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। বিসিবির দৃষ্টিতে, যেহেতু পাকিস্তানই স্বাগতিক দেশ, তাই তাদের দিক থেকে নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আসা জরুরি। পিসিবিও এখন পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার না করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কথাই জানিয়েছে।
এশিয়া কাপ এবং পরবর্তী সিরিজও ঝুলে
বাংলাদেশ দলের পাকিস্তান সফর নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও এটি একক কোনো ইস্যু নয়। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে এশিয়া কাপসহ অন্যান্য সিরিজগুলোর ভবিষ্যত নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। এশিয়া কাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ ঘিরে চিরাচরিত টানাপোড়েন, এবার আরও তীব্র হয়েছে সীমান্ত সংঘর্ষ ও যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে। এর ফলে টুর্নামেন্টের ভেন্যু ও কাঠামো নিয়েও ভাবতে হচ্ছে আয়োজকদের।
খেলোয়াড় ও বোর্ডের অভ্যন্তরীণ অবস্থান
বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের বড় অংশই নিরাপত্তার বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বোর্ড জানে, খেলোয়াড়দের মানসিক স্বস্তি ছাড়া আন্তর্জাতিক সফর সফল হতে পারে না। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কা দলের ওপর পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার স্মৃতি এখনো তাজা। সেই অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখেই বিসিবি এবার একাধিক দিক বিশ্লেষণ করছে। অভ্যন্তরীণভাবে বিসিবির বেশিরভাগ পরিচালকও চান না পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কোনো তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিতে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি
পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) বিগত কয়েক বছরে নিজেদের দেশে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনের চেষ্টা করেছে এবং তাতে কিছুটা সফলতাও পেয়েছে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বেশ কিছু দেশ পাকিস্তানে খেলে এসেছে। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধাবস্থা পুনরায় সেই স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সফর করলে তা একদিকে খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে, অন্যদিকে আবার সম্পর্ক রক্ষার কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও তৈরি করতে পারে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের পাকিস্তান সফর এখনো ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন। বিসিবি পরিস্থিতি বিবেচনা করে কৌশলগত ধৈর্য অবলম্বন করছে, যা দায়িত্বশীল পদক্ষেপ হিসেবেই দেখা যেতে পারে। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা পরিস্থিতি শান্ত করার ইঙ্গিত দিলেও, মাঠে তার প্রতিফলন না দেখা পর্যন্ত বাংলাদেশ কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাবে না বলেই বোর্ড সূত্র জানায়।
এই মুহূর্তে বিসিবির দৃষ্টি শুধু আমিরাত সফরের দিকে, যেখানে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি নেই বললেই চলে। পাকিস্তান সফরের ভাগ্য নির্ধারণ হবে আগামী কিছুদিনের মধ্যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে হয়তো সফরও অনুষ্ঠিত হবে, আর বিপরীতে হলে সফর পিছিয়ে দেওয়া বা স্থগিত হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ