
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সব ধরনের প্রচারণা কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, অনলাইন ও প্রিন্ট গণমাধ্যমসহ যেকোনো মাধ্যমে দলটির পক্ষে প্রচার, বিবৃতি, জনসমাবেশ, সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা, সংবাদ সম্মেলন এবং মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আজ রবিবার এ সংক্রান্ত নতুন একটি অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যার মাধ্যমে কার্যকর হলো সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫।
অধিবেশন ছাড়াই এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে দেশের বিদ্যমান সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এ বড় ধরনের সংশোধন আনা হলো, যার অন্যতম লক্ষ্য হলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত দল বা গোষ্ঠীগুলোর প্রচারণা ক্ষমতা সীমিত করে তাদের রাজনৈতিক ও জনসম্পৃক্ত কার্যক্রমকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা।
অধ্যাদেশের মূল প্রতিপাদ্য: সন্ত্রাসে জড়িত সত্তার প্রচারণা নিষিদ্ধ
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, “সন্ত্রাসী কার্য প্রতিরোধ এবং উহাদের কার্যকর শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ প্রণীত হয়। তবে তাতে কোনো রাজনৈতিক দল বা সত্তার ‘কার্যক্রম নিষিদ্ধের’ জন্য সরাসরি কোনো বিধান ছিল না। ফলে আইনটিকে সময়োপযোগী করতে এবং সংঘবদ্ধভাবে রাষ্ট্র ও সমাজবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে আইনটির সংশোধন জরুরি হয়ে পড়ে।”
সেই প্রেক্ষাপটে নতুন অধ্যাদেশে স্পষ্টভাবে যুক্ত করা হয়েছে—যদি সরকার যুক্তিসংগত প্রমাণ পায় যে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দল সন্ত্রাসে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তবে তাদের প্রচার, প্রকাশনা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, এমনকি অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা যাবে।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ: গেজেট কাল
সংশোধনী অধ্যাদেশটি অনুমোদনের পর এখন তার বাস্তবায়ন শুরু হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম জানান, “আগামীকাল সোমবার এ বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করা হবে। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পক্ষে বা সমর্থনে প্রকাশিত সকল প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ড আইনত নিষিদ্ধ হবে।”
যুব উপদেষ্টার ফেসবুক পোস্টে নিশ্চিতকরণ
আজ বিকেলে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিস মাহমুদ তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এই নিষেধাজ্ঞার ব্যাখ্যা দিয়ে লেখেন,
“আওয়ামী লীগের পক্ষে বা সমর্থনে কোনো প্রেস বিবৃতির প্রকাশনা বা মুদ্রণ কিংবা গণমাধ্যম, অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে যেকোনো ধরনের প্রচারণা, অথবা মিছিল, সভা-সমাবেশ বা সংবাদ সম্মেলন আয়োজন বা জনসমক্ষে বক্তৃতা প্রদান নিষিদ্ধ করা হবে।”
তিনি আরও লেখেন, “এটা কেবল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং একটি আইনি পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে আমরা একটি জবাবদিহিমূলক এবং সন্ত্রাসমুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে চাই। কেউ আইন অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
আইনের সংশোধন: কী কী পরিবর্তন এলো?
সংশোধিত আইন অনুযায়ী, সরকার যদি সন্তোষজনকভাবে প্রমাণ পায় যে কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক সত্তা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত, তাহলে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন জারি করে সেই ব্যক্তি বা সংগঠনকে নিষিদ্ধ এবং তফসিলভুক্ত করতে পারবে। এ ছাড়া যেকোনো অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন সত্তার পক্ষে প্রচারণা, প্রকাশনা বা সমর্থনমূলক পোস্টকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে।
নতুন অধ্যাদেশের মাধ্যমে যা স্পষ্ট হয়েছে, তা হলো—কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী যদি জননিরাপত্তা, ধর্মীয় বিদ্বেষ, রাজনৈতিক সহিংসতা, রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, তাহলে তাদের প্রচারণা এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পূর্ণ অধিকার সরকারের থাকবে।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে সিদ্ধান্তের তাৎপর্য
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর এবং বিতর্কিত মোড়। রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা, মতপ্রকাশের অধিকার এবং প্রচারণা স্বাধীনতা—এই তিনটি মৌলিক বিষয়কে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে যাচ্ছে এই অধ্যাদেশ।
এদিকে রাজনৈতিক মহলে বিষয়টি নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করছে এটি একটি আইনগত পদক্ষেপ, বিরোধীরা বলছেন—এটি রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণ অভিযানের নাম করে একতরফাভাবে একটি দলের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা।
ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট
নিষেধাজ্ঞা কবে পর্যন্ত বহাল থাকবে কিংবা তা নির্বাচনের প্রাক্কালে কীভাবে কার্যকর থাকবে—এই প্রশ্নগুলো এখন সামনে আসছে। অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, “দেশকে সহিংসতা ও উগ্রবাদমুক্ত করতে হলে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে যেসব শক্তি রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমে জড়িত, তাদের মুখোশ উন্মোচন এবং প্রচারণা থেকে সরিয়ে দেওয়া এখন সময়ের দাবি।”
সেই হিসেবে, আওয়ামী লীগের পক্ষে কোনো সংবাদপত্রের কলাম, টেলিভিশনে বিশ্লেষণ, সামাজিক মাধ্যমে সমর্থনসূচক পোস্ট, এমনকি দলীয় নেতাদের জনসম্মুখে বক্তব্য—সবই এখন আইনত দণ্ডনীয় হতে পারে।
একইসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে অন্য দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও একই রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে, যদি তাদের বিরুদ্ধেও সন্ত্রাস বা রাষ্ট্রবিরোধিতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ