
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ কয়েকদিনের উত্তেজনা ও সংঘাতের পর অবশেষে ভারত ও পাকিস্তান শনিবার (১০ মে) আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়। কিন্তু এই স্বস্তির খবর বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। যুদ্ধবিরতির মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর নতুন করে সংঘর্ষের অভিযোগ উঠেছে। দুই দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। এতে করে যুদ্ধের আশঙ্কা পুরোপুরি কাটেনি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
সম্প্রতি ভারতের ‘অপারেশন সিন্দুর’ এবং পাকিস্তানের ‘অপারেশন বুনিয়ান মারসুস’ ঘিরে জম্মু-কাশ্মীর অঞ্চলে সেনা ও গোলাবর্ষণের প্রচণ্ড উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সীমান্তের দুপাশে গোলাগুলির মুখে প্রাণহানি ঘটে, বহু মানুষ উদ্বাস্তু হন। এ অবস্থায় মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দেন, ‘রাতভর আলোচনার পর ভারত ও পাকিস্তান পূর্ণমাত্রিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’
পরবর্তীতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে ৪৮ ঘণ্টার কূটনৈতিক আলোচনার ফলেই এই যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত আসে।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পরপরই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, “পাকিস্তান একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে আচরণ করেছে। আমরা নয়াদিল্লির আক্রমণের উপযুক্ত জবাব দিয়েছি।”
তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যস্থতাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “অপারেশন বুনিয়ান মারসুস সফল হয়েছে। আগামীকাল আমরা পাকিস্তানজুড়ে জাতীয় কৃতজ্ঞতা দিবস ‘ইয়াওমে তাশাক্কুর’ পালন করবো।”
শেহবাজ আরও বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমেই পানি সম্পদ, কাশ্মীর ও সীমান্ত সমস্যার ন্যায়সংগত সমাধান সম্ভব।”
তবে আশাবাদের রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয় নতুন করে উত্তেজনা। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, শনিবার রাতেই ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগরের আকাশে অজানা উড়ন্ত বস্তু দেখতে পান স্থানীয়রা। ভারতের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি দিলেও পাকিস্তান তা লঙ্ঘন করেছে। নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর একাধিকবার গোলাগুলি চালানো হয়েছে। আমরা শান্তি চাই, কিন্তু যদি উসকানি দেওয়া হয়, তবে উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন শুধু চুক্তিভঙ্গই নয়, বরং এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।”
অন্যদিকে পাকিস্তান ভারতের অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “ভারতের কিছু সীমান্তচৌকি থেকে গুলিবর্ষণের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করা হয়েছে। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দায়িত্বশীলতা ও সংযমের পরিচয় দিয়েছে।”
পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার বলেন, “পাকিস্তান কখনোই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের কথা ভাবেনি, করবে না। আমাদের প্রতিক্রিয়া ছিল আত্মরক্ষামূলক। এখন দেশের মানুষ উৎসবমুখর। আমরা বিজয়ী হয়েছি।”
এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাতিসংঘও নতুন করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর সংঘর্ষ পুনরায় শুরু হওয়া গভীর উদ্বেগের বিষয়। দুই দেশের উচিত দ্রুত সমঝোতায় পৌঁছানো।”
বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধবিরতির এমন লঙ্ঘন কেবল সামরিক উত্তেজনা বাড়ায় না, বরং কূটনৈতিকভাবে একটি নেতিবাচক বার্তাও দেয় আন্তর্জাতিক মহলে। বিশেষ করে যখন মধ্যস্থতায় মার্কিন নেতৃত্ব থাকছে, তখন এমন ঘটনা ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার মধ্য দিয়ে ভারতে-পাকিস্তানে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লেও কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তা আবার নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসরত সাধারণ মানুষের চোখে শান্তি এখনও এক অলীক স্বপ্নই রয়ে গেছে। এখন দেখার বিষয়, ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় অর্জিত এ চুক্তি কতটা কার্যকর থাকে এবং দুই পরাশক্তির রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরীক্ষায় কে কিভাবে উত্তীর্ণ হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ