
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ দুই বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, অসংখ্য প্রাণহানি ও ইউরোপজুড়ে এক নজিরবিহীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই অবশেষে আলো দেখছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি। শনিবার (১০ মে) গভীর রাতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক টেলিভিশন ভাষণে ইউক্রেনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন। এই প্রস্তাব আসার সময়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ—কারণ এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইউরোপের চার প্রধান দেশের শীর্ষ নেতারা কিয়েভে উপস্থিত হয়ে রাশিয়াকে এক চরম আলটিমেটাম দেন: “১৫ মে’র মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করুন, না হলে আসছে নতুন নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক সহায়তার ঢল।”
টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, “আমরা ইউক্রেনের সঙ্গে গুরুতর, অর্থবহ আলোচনায় বসতে চাই। এই আলোচনা অবিলম্বে শুরু হওয়া উচিত এবং ১৫ মে থেকেই তা শুরু করা সম্ভব। আমাদের উদ্দেশ্য সংঘাতের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে একটি দীর্ঘমেয়াদী, টেকসই শান্তির পথে অগ্রসর হওয়া।”
পুতিনের এ ঘোষণাকে রুশ অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিসরেও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে রাশিয়া একাধিক আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিলেও সম্প্রতি ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ ও পশ্চিমা চাপের মুখে ক্রেমলিনের অবস্থান কিছুটা নমনীয় হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
রুশ প্রেসিডেন্টের শান্তির আহ্বান একদিকে যেমন বহু মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে, অন্যদিকে এটি এক স্পষ্ট কূটনৈতিক কৌশলের অংশ বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। কারণ পুতিনের ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগেই ইউরোপের চার শীর্ষ নেতা—যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ মের্ৎস এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেইন—একসঙ্গে কিয়েভে পৌঁছান। এটাই ইতিহাসে প্রথম, যখন ইউক্রেন সফরে একসঙ্গে উপস্থিত হন এত উচ্চপর্যায়ের ইউরোপীয় নেতারা।
তারা কিয়েভে দাঁড়িয়ে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একযোগে অবস্থান জানান এবং প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের সময় স্পষ্টভাবে রাশিয়াকে ১৫ মে’র মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার চূড়ান্ত সময়সীমা দেন। অন্যথায়, ইউরোপ আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তারা।
ইউরোপীয় নেতারা কিয়েভে এসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে একত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ফোন করেন। এই আলোচনায় কূটনৈতিকভাবে সমন্বিত অবস্থান গ্রহণের বার্তা স্পষ্ট হয়। ট্রাম্প বলেন, “আমি আশা করি পুতিন এই বার্তা বুঝবেন—এই যুদ্ধ বন্ধ করা এখন শুধু ইউরোপের দাবি নয়, বরং পুরো বিশ্বের দাবি।”
ফোনালাপের পর কিয়েভে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জেলেনস্কি ঘোষণা দেন, “আমরা রাশিয়াকে একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছি, যা আকাশ, স্থল ও সমুদ্র—তিন ক্ষেত্রেই কার্যকর হবে। মস্কো যদি এতে সম্মত না হয়, তবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ব্যাংক, জ্বালানি ও প্রযুক্তি খাতে আরও কঠোর হবে।”
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেইন বলেন, “আমরা পুতিনকে সুযোগ দিয়েছি শান্তির পথে আসার জন্য। তিনি যদি এই হাত বাড়িয়ে দেয়া প্রস্তাব গ্রহণ না করেন, তাহলে কঠিন নিষেধাজ্ঞা চালু হবে—এমনকি রাশিয়ার ওপর আর্থিক ও জ্বালানি খাতে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করা হবে।”
এদিকে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ মের্ৎস আরও সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “এই যুদ্ধ চলতে থাকলে আমরা শুধু সহায়তা চালিয়ে যাব না, বরং তা আরও বাড়ানো হবে—সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে।”
এই মুহূর্তে ইউক্রেন যুদ্ধ এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে। একদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট সরাসরি আলোচনায় বসার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন, অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব এই সুযোগে তাকে রাজি করিয়ে নিতে সর্বাত্মক চাপ প্রয়োগ করছে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, “যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে, আমরা চাই কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যে সরাসরি আলোচনা হোক। এটি সময়ের দাবি। আমরা দেখেছি, যুদ্ধ আর মৃত্যু এই অঞ্চলকে ধ্বংস করেছে। শান্তিই একমাত্র পথ।”
পুতিনের সরাসরি আলোচনার প্রস্তাবকে অনেকেই ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখলেও এটি সফল হবে কিনা তা নির্ভর করছে পশ্চিমা চাপ, ইউক্রেনের প্রতিক্রিয়া এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে—পুতিনের বাস্তব সিদ্ধান্তের ওপর। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে বিশ্ব নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করতে পারে, নতুবা এটি কেবল আরেকটি 'কৌশলগত প্রস্তাব' হয়েই থেকে যেতে পারে। এখন প্রশ্ন একটাই: পুতিন কি এবার সত্যিই শান্তির পথে হাঁটবেন?
বাংলাবার্তা/এমএইচ