
ছবি: সংগৃহীত
টানা কয়েক দিন ধরে চলা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ভয়াবহ সশস্ত্র সংঘাতের পর অবশেষে উভয় পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্ত যতটা শান্তির বার্তা বহন করছে, বাস্তব পরিস্থিতি ততটাই অনিশ্চয়তায় ঘেরা। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই যুদ্ধবিরতিকে ‘ব্যক্তিগত সাফল্য’ দাবি করেছেন, কিন্তু সীমান্তজুড়ে এখনও বিস্ফোরণের শব্দ, ধোঁয়ার কুন্ডলী ও সামরিক প্রস্তুতির দৃশ্য পরিস্থিতির নাজুকতাই স্পষ্ট করছে।
গতকাল সন্ধ্যায় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি জানান, বিকাল ৩টা ৩৫ মিনিটে পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশন (ডিজিএমও) ফোন করে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন এবং ভারত তা গ্রহণ করে। সন্ধ্যা ৫টা থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। উভয় দেশের সামরিক বাহিনীকে স্থল, জল এবং আকাশপথে সব ধরনের হামলা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এই ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে পর্যন্ত সীমান্তজুড়ে চলছিল চরম উত্তেজনা, যেখানে উভয় পক্ষই হামলা-পাল্টা হামলায় লিপ্ত ছিল। এমন অবস্থায় হঠাৎ যুদ্ধবিরতির খবর আসায় কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আলোচনায় এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর মালিকানাধীন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি দাবি করেন, দীর্ঘ রাতের আলোচনার পর তাঁর মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। তিনি বলেন, “সাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও অসাধারণ বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়ার জন্য উভয় দেশকে অভিনন্দন।” তবে এই দাবির পক্ষে কোনো সরকারি সূত্র নিশ্চিত করেনি।
গত শুক্রবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তান দুই পক্ষই ব্যাপক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।
ভারতীয় হামলা: পাকিস্তানের রফিকি, মুরিদ, চাকলালা, রহিম ইয়ার খান, সুক্কুর ও চুনিয়া বিমান ঘাঁটিতে দফায় দফায় আক্রমণ চালানো হয়। ভারত দাবি করেছে, এসব ঘাঁটি কার্যত অচল হয়ে গেছে।
পাকিস্তানের জবাব: ভারতীয় ঘাঁটি আদমপুর, উধমপুর, পাঠানকোট, সুরতগড় ও সিরসায় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। পাকিস্তান দাবি করে, এসব হামলায় ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, পাল্টা অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন বনিয়ান মারসুস’, যার আওতায় পাকিস্তান আক্রমণ শুরু করে ভারতের মূল ঘাঁটিগুলোতে। পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান থেকে উৎক্ষেপণ করা জেএফ-১৭ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের এস-৪০০ সিস্টেম ও ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণ কেন্দ্র ধ্বংস করেছে বলেও দাবি করা হয়।
ভারতের সেনাবাহিনীর কর্নেল সুফিয়া কুরেশি এবং উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংহ এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, পাকিস্তানের হামলায় স্কুল ও হাসপাতালও টার্গেট ছিল। তাদের ভাষায়, “বেপরোয়া ও কাপুরুষোচিত হামলা চালানো হয়েছে।”
বিশেষত ভাটিন্ডা, ভূজ, পাঠানকোট ও উধমপুরে চালানো হাইস্পিড মিসাইল হামলায় সেনা ও অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিবিসি ও আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রীনগরে স্থানীয় সময় সকাল ৬টার আগে পরপর কয়েকটি বিশাল বিস্ফোরণ হয়, যার ফলে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে শহরজুড়ে। জম্মুর শম্ভু মন্দিরে এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার খবরও নিশ্চিত হয়েছে।
পাকিস্তানের সিভিল এভিয়েশন অথরিটি ঘোষণা করে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সমস্ত বেসামরিক বিমান চলাচল বন্ধ থাকবে। অন্যদিকে ভারত ১৫ মে পর্যন্ত উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের ৩২টি বিমানবন্দর সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে।
পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার জিও নিউজে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা চাই ভারত সংঘাতের পথ পরিহার করে সংলাপে আসুক। আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই।”
তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক আন্তর্জাতিক নেতা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মার্কো রুবিও পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনিরের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং সংঘাত প্রশমনে সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মাথায় আবারও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে শ্রীনগরে। ভারতীয় সরকারি সূত্র বলছে, পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। তবে পাকিস্তান পক্ষ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, স্থলযুদ্ধের সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ট্রাম্পের প্রকাশ্য ‘মধ্যস্থতা সাফল্য’ ঘোষণার পর যুদ্ধবিরতি বাস্তবে কতটা স্থায়ী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সীমান্তে সামরিক প্রস্তুতি, বিমানঘাঁটি ধ্বংস, বেসামরিক অবকাঠামোতে হামলা এবং পারস্পরিক দোষারোপ পরিস্থিতিকে যেকোনো সময় আবার সহিংসতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ভারতের ‘স্ট্র্যাটেজিক পেস’ এবং পাকিস্তানের ‘মিরর রেসপন্স’ এই উত্তেজনাকে দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে পরিণত করতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ