
ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াকে ঘিরে দেশ-বিদেশে যখন নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে, তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক বিবৃতিতে বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন না যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করায় বিশ্ব সম্প্রদায় কোনো ধরনের শোক বা প্রতিবাদ জানাবে। বরং দলটির বিরুদ্ধে আনা গুরুতর অভিযোগ ও নিরাপত্তাজনিত বাস্তবতায় নিষেধাজ্ঞা একেবারেই যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয় ছিল বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
রোববার (১১ মে) সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া একটি বিশ্লেষণধর্মী পোস্টে প্রেস সচিব এ বক্তব্য দেন। এই পোস্টে তিনি শুধুমাত্র দল নিষিদ্ধকরণের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেননি, বরং এর আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত, ইতিহাস এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র তুলে ধরেন।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম স্পষ্ট ভাষায় লেখেন, “জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য এই নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজনীয় ছিল। আওয়ামী লীগের কার্যকলাপ ছিল রাষ্ট্রবিরোধী, মানবতাবিরোধী এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য মারাত্মক হুমকি।”
তিনি আরও বলেন, “এই দলটি দীর্ঘদিন ধরে একটি ছায়া-রাষ্ট্রের মতো কাজ করেছে। তারা দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করেছে, বিচারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে এবং নির্বাচনকে অর্থহীন করে তুলেছে। এসব কাজ ছিল গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক সুপরিকল্পিত আঘাত।”
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশকারীদের উদ্দেশে শফিকুল আলম বলেন, “আমরা দেখেছি মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং মূল জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য এমনকি পশ্চিমা গণতন্ত্রেও সমগ্র রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে— কেবল তাদের কার্যক্রম নয়।”
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি ও ইতালিতে নাৎসি ও ফ্যাসিস্ট দলগুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এমনকি আধুনিক ইউরোপেও যেমন স্পেন ও বেলজিয়ামে নির্দিষ্ট দলগুলোকে অবসানমূলক ও সহিংস কার্যকলাপের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।”
প্রেস সচিব তার পোস্টে আরও বলেন, “জাতিসংঘের রিপোর্টে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব, দলীয় কর্মীরা এবং সহযোগী সংগঠনগুলো মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধে অংশ নিয়েছিল। তারা খুন, গুম, নারী ধর্ষণ, রাজনৈতিক নিপীড়নসহ একাধিক অপরাধে জড়িত ছিল।”
তিনি বলেন, “এই দলটির নেতৃত্বের অংশগ্রহণে ব্যাংক লুট হয়েছে, বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, এবং জনগণের সম্পদ ব্যক্তিগতভাবে দখল করা হয়েছে। এটি কেবল দুর্নীতির দল নয়, বরং একটি অপরাধী চক্র।”
প্রেস সচিব শফিকুল আলম অভিযোগ করেন, “আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে এবং নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে। তারা রাষ্ট্রের সকল স্তরে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে এবং জনমতকে দমন করতে ভয়ভীতি ও রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করেছে।”
শফিকুল আলম বলেন, “আমি বিশ্বাস করি না, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার জন্য বিশ্ব বিলাপ করবে। গণতান্ত্রিক বিশ্বে এমন কেউ নেই যে নির্লজ্জ খুনি, গণতন্ত্রবিরোধী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দলের পক্ষে কথা বলবে।”
তিনি আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিজেরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে অবস্থান নেয়। তারা জনগণের অধিকার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এমন অবস্থায় একটি দুঃশাসনের প্রতীক দল নিষিদ্ধ হওয়ায় আন্তর্জাতিক মহলে শোক বা প্রতিক্রিয়া আসার প্রশ্নই ওঠে না।”
প্রেস সচিবের পোস্টে পরোক্ষভাবে বর্তমান নিষেধাজ্ঞা নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বিশ্লেষকদের দিকেও বার্তা ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা দেখেছি যারা মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, তারাও এখন নিরুত্তর। সময়ের প্রয়োজনে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা ইতিহাসে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দিকেই এক বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে।”
প্রেস সচিব শফিকুল আলমের পোস্টে স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়েছে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণকে শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং জাতীয় স্বার্থে জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে তুলে ধরতে চায়। তার মতে, এটি কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের যোগ্য ঘটনা নয়, বরং একটি অপরাধী সংগঠনের আইনি অবসান।
বাংলাবার্তা/এমএইচ